ঢাকা ০৫:৩২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৩১ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
বাংলাদেশে আসছেন হানিয়া আমির রোহিঙ্গা সুন্দরী তৈয়বার মালয়েশিয়ায় ‘বিয়ে বাণিজ্য’ নারায়ণগঞ্জে ফ্ল্যাট থেকে স্বামী-স্ত্রী ও ছেলের মরদেহ উদ্ধার ১৭ দিন পর হাসপাতাল ছাড়লেন সাবেক ভিপি নুর কুতুবদিয়ায় জলদস্যু,মাদক ও সন্ত্রাস দমনে থানা, কোস্ট গার্ড এবং মৎস্য অফিসের যৌথ সচেতনতামূলক সভা তারেক রহমান শিগগিরই দেশে ফিরবেন এম রশিদুজ্জামান মিল্লাত জামালপুরের বকশীগঞ্জে দশানি নদীতে অভিযান চালিয়ে বিপুল চায়না জাল ও কারেন্ট জাল জব্দ করা হয়েছে বর্ণাঢ্য আয়োজনে পবিপ্রবির তাপসী রাবেয়া হলে নবীনবরণ উৎসব ঠাকুরগায়ের হরিপুরে প্রীতি ফুটবল টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত শ্যামনগরে জলবায়ু পরিবর্তনে মানবাধিকার নিশ্চিতকরনে এনগেজ প্রকল্পের অবহিতকরণ সভা অনুষ্ঠিত

রোহিঙ্গা সুন্দরী তৈয়বার মালয়েশিয়ায় ‘বিয়ে বাণিজ্য’

ডেস্ক রিপোর্ট
  • আপডেট সময় : ০২:১৮:২৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ২১ বার পড়া হয়েছে

১৯৯৭ সালে মিয়ানমারের মংডু থেকে পালিয়ে এসে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয় রোহিঙ্গা নারী সুরুজ জামানের পরিবার।

সুরুজের প্রথম সন্তান তৈয়বা আক্তার অবৈধ উপায়ে তৈরি করেছেন বাংলাদেশি পাসপোর্ট। আর সেই পাসপোর্টে তিনি নিয়মিত অবাধে মালয়েশিয়া যাতায়াত করছেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিসহ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তৈয়বার রয়েছে একাধিক স্বামী। এছাড়াও বিয়ের নামে অভিনব প্রতারণার ফাঁদে ফেলে অসংখ্য বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা যুবককে তিনি করেছেন নিঃস্ব।

কে এই তৈয়বা?
উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ‘রোহিঙ্গা সুন্দরী মালয়েশিয়ান তৈয়বা’ নামে ব্যাপক আলোচিত এই নারী। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য প্রদত্ত এমআরসি কার্ড (শরণার্থী পারিবারিক প্রত্যায়ন পত্র) এর তথ্যানুযায়ী উখিয়ার কুতুপালং নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের (কুতুপালং আরসি) বি-ব্লকের বাসিন্দা। এমআরসি নং- ১৮৫৭০ ক্রমিকের কার্ডটির তথ্য বলছে, ওই ব্লকের ৪১নং শেডে বাস করা তৈয়বা আক্তারের জন্ম ১৯৯৪ সালের ১ জানুয়ারি। এছাড়া কার্ডটিতে তৈয়বার মা সুরুজ জামান ও ভাই নুরুল আফসারসহ পরিবারের ৫ সদস্যের তথ্য রয়েছে।

ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৬ বছর আগে মালেয়শিয়া প্রবাসী এক রোহিঙ্গা যুবকের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে কুয়ালালামপুরে পাড়ি জমান তৈয়বা। সেই যুবকের সাথে বিচ্ছেদের পর অন্তত ৬ জনকে তিনি বিয়ে করেছেন। এছাড়াও প্রেমের সম্পর্ক গড়ে বিয়ের আশ্বাসে আরও ৭/৮ জন যুবকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল অংকের অর্থ।

তৈয়বার এক প্রতিবেশী বলেন, সে মালয়েশিয়ায় থাকে মাস ছয়েক। এরপর এখানে বেড়াতে আসে। সেখানে এক ছেলে তাকে বিয়ে করে নিয়ে গিয়েছিল, পরে শুনেছি তাদের বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। এখন নাকি নতুন বিয়ে করেছে। তবে তার আসল স্বামীকে আমরা চিনি না, সে খুব বিলাসি চলাফেরা করে।

রোহিঙ্গা হয়েও কিভাবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট পেলেন তৈয়বা?
এই নারীর বর্তমান ব্যবহৃত বাংলাদেশি পাসপোর্ট নম্বর হচ্ছে – ইএম০১৮..

…। ২০২৩ সালের ২০ নভেম্বর ইস্যুকৃত সেই পাসপোর্টের তথ্যানুযায়ী, তৈয়বার ঠিকানা নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলার ভূঁইয়ারহাটের চন্দ্রসুদ্দি গ্রামে। পাসপোর্টে বাবার নাম লেখা হয়েছে বাবুল মিয়া ও তার আসল মা সুরুজ জামান হলেও মায়ের নাম লেখা আছে আমেনা খাতুন। এছাড়াও স্বামীর নামের স্থলে আছে দাদন মিয়া এবং জরুরি যোগাযোগের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে – ৩৬ পুরানা পল্টন, ঢাকা জিপিও, পল্টন, ঢাকা। এমআরসি কার্ডের সাথে প্রায় ৫ বছর ব্যবধান রেখে পাসপোর্টে জন্ম তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ১০ মার্চ ১৯……. এবং প্রদত্ত জন্ম নিবন্ধন নং- ১৯৯৯১৯২০………..।

বাস্তবে তৈয়বার এই পরিচয় সম্পূর্ণ ভূয়া বলে তার মূল ঠিকানা কুতুপালংয়ে নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। পাশাপাশি এমআরসি কার্ডে প্রদত্ত ছবি ও পাসপোর্টের ছবির মধ্যে তৈয়বার মুখমণ্ডলের যথেষ্ট মিল পরিলক্ষিত হয়েছে। এছাড়াও প্রতিবেদকের হাতে তৈয়বার ব্যবহৃত আরও একটি পুরাতন পাসপোর্ট (ইবি০৫১২…) এর স্ক্যান কপি সংরক্ষিত আছে।

১৯৭৩ এর পাসপোর্ট আইন অনুযায়ী, শুধুমাত্র বাংলাদেশের নাগরিকরাই বৈধভাবে পাসপোর্ট পেতে পারেন এবং বিদেশি বা শরণার্থী (যেমন রোহিঙ্গা) কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশি পাসপোর্ট পাওয়ার যোগ্য নন। আইনের ১১নং ধারায় বলা আছে, ভুয়া তথ্য দিয়ে বা মিথ্যা পরিচয় দিয়ে পাসপোর্ট নেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যার শাস্তি সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানা, অথবা উভয়ই হতে পারে।

রোহিঙ্গা যুবক আতিকের ২০ লাখ টাকা আত্মসাৎ
২ বছর আগে মুঠোফোনে তৈয়বার পরিচয় ঘটে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ২৫ বছর বয়সী তরুণ মোহাম্মদ আতিকের সাথে। নিয়মিত যোগাযোগের মধ্যে তৈরি হয় প্রেমের সম্পর্ক। আতিককে বিয়ে করে মালয়েশিয়া নিয়ে যাবেন জানিয়ে বিভিন্ন সময় তার কাছ থেকে তৈয়বা হাতিয়ে নেন টাকা। একপর্যায়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তৈয়বা। নিজের সবটুকু হারিয়ে নিঃস্ব আতিক জানতে পারেন এই নারী একজন প্রতারক।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি তাকে বিশ্বাস করে ভালোবেসেছি, যখন যা চেয়েছে দিয়েছি। সে আমার কাছ থেকে কমপক্ষে ২০ লাখ টাকা নিয়েছে। অনেক স্বপ্ন ছিল সংসার করবো মালয়েশিয়ায় নতুন জীবন গড়বো। কিন্তু সে একটা প্রতারক বলে পরে জানতে পেরেছি। দুই মাস আগে বাংলাদেশে সে এসেছে শুনে অনেক চেষ্টা করেও টাকা ফেরত পাইনি।

আতিক দাবি করেন, মালয়েশিয়ায় তার অনেক স্বামী আছে। সে কিছুদিন পর আবারও সেখানে চলে যাবে। আমার মতো অনেকের সাথে একই কাজ করেছে এবং করতে থাকবে কারণ এটা তার পেশা। আল্লাহ তার বিচার করবে।

মালয়েশিয়ায় ‘অবৈধ’ বিয়ে বাণিজ্য
বিয়ের নামে প্রতারণায় সিদ্ধহস্ত রোহিঙ্গা তরুণী তৈয়বার হাতে প্রতারিত আতিক ছাড়াও আরও কয়েকজন ভুক্তভোগী তরুণের অভিযোগ মিলেছে যারা মালয়েশিয়ায় বাস করেন। প্রতারিতদের মধ্যে রোহিঙ্গা ছাড়াও আছেন বাংলাদেশি, কানাডিয়ান ও পাকিস্তানি নাগরিক।

২০১৯ সালের শেষের দিকে রোহিঙ্গা যুবক সালামতউল্লাহর সাথে পরিচয়ের পর ধর্মীয়ভাবে তৈয়বার বিয়ে হয়। কুয়ালালামপুরের শহরতলীতে সবজি-ফল এর দোকান নিয়ে ভালোই জীবন যাচ্ছিল সালামতের। কিন্তু তৈয়বার ফাঁদে পড়ে হারাতে হয় ব্যবসা থেকে শুরু করে কষ্টার্জিত সব অর্থ।

সালামত উল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, পরিবারের জন্য পাঠাতে হবে, জমি কিনতে হবে মিথ্যা তালবাহানা করে মাত্র ১ বছরের সংসার জীবনে সে আমার ৩০ লাখ টাকার বেশি ক্ষতি করেছে। আমি বিশ্বাস করে ঠকেছি, সব হারিয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছি। কানাডা প্রবাসী রহিমউল্লাহ নামে এক রোহিঙ্গা যুবককে মালয়েশিয়ায় বিয়ের কথা বলে নিয়ে আসেন তৈয়বা।

রহিমউল্লাহর এক বন্ধু বলেন, তৈয়বার প্রলোভনে পড়ে রহিমউল্লাহ স্ত্রী-সন্তান ছেড়ে মালেয়শিয়া গিয়েছিলেন। হোটেলে অবৈধভাবে অবস্থান করে রহিমের ভিডিও ধারণ করে তৈয়বা তাকে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকলে সে বিপুল টাকা দিয়ে কানাডা ফিরে যায়। একই কাজ এক পাকিস্তানির সাথেও করেছে বলে শুনেছি। এছাড়াও অনুসন্ধানে মেহেদী নামে এক বাংলাদেশি তরুণের তথ্য পাওয়া গেছে যিনিও তৈয়বার হাতে একইভাবে প্রতারণার শিকার হয়েছেন।

মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ী আমিনুল হাকিম বলেন, অবৈধভাবে বিয়ে বাণিজ্য করে অসংখ্য যুবক ভাইদের তৈয়বা নামের রোহিঙ্গা নারী মালয়েশিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণা করে বেড়াচ্ছে। সে খুব চতুর, অপকর্মে ঢাকতে এখানে বারবার স্থান পরিবর্তন করে। তার শাস্তি হওয়া উচিত যেন সে কখনো মালয়েশিয়া আসতে না পারে।

অবৈধ পাসপোর্ট থেকেও কেন অধরা এই রোহিঙ্গা নারী?
ঢাকার উত্তরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে পাসপোর্ট করতে এসে ২০২২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ধরা পড়েন হতিজা আক্তার নামে এক রোহিঙ্গা নারী। হতিজা ওই সময় পাসপোর্ট কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছিলেন, মালয়েশিয়ায় অবস্থানকারী এক ছেলের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। ওই ছেলের পরামর্শে পাসপোর্ট তৈরি করে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পরিকল্পনা করেন তিনি। গত ২৭ আগস্ট ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে পাসপোর্ট করতে এসে ধরা পড়েন এক রোহিঙ্গা নারী।

এনআইডি ও অন্যান্য কাগজপত্র জমা দিলেও শেষ পর্যন্ত বায়োমেট্রিক যাচাইয়ের সময় তার আসল পরিচয় প্রকাশ পায়। এসময় আটক নারীর স্বামী পরিচয় দেওয়া বাংলাদেশি যুবক মেজবাহকেও আটক করা হয়। এরপর দিন ২৮ আগস্ট চট্টগ্রামে ভুয়া তথ্য ব্যবহার করে পাসপোর্ট করতে যাওয়া দুই রোহিঙ্গা নাগরিককে আটক করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

পাসপোর্ট করতে গিয়ে এসব রোহিঙ্গারা ধরা পড়লেও অবৈধভাবে পাসপোর্ট বানিয়ে ফেলতে সক্ষম হওয়া তৈয়বারা রয়ে যাচ্ছেন অধরা।

উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মীর সাহেদুল ইসলাম বলেন, বিগত সময় অনেক রোহিঙ্গা পাসপোর্ট ও এনআইডি দালালদের মাধ্যমে মোটা টাকায় বানিয়েছে। এখন সেই সুযোগ আর নেই, আমরা প্রতিটি তথ্য যাচাই করি খুব সুক্ষভাবে। অতীতে এসব অপকর্মে যারা জড়িত ছিল তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত, একই সাথে অবৈধ পাসপোর্টগুলো শনাক্ত করে বাতিল করা উচিত বলে মনে করি।

কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মোবারক হোসেন বলেন, আবেদনকারীদের সন্দেহ হলে তাদের কাগজপত্র যাচাই করতে গিয়ে জালিয়াতি ধরা পড়ে। আর দালালদের দৌরাত্ম অনেকাংশে এখন কমে এসেছে, আমরা এই বিষয়ে সতর্ক আছি।

রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট করার কোনো সুযোগ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, আগে পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রথা চালু ছিল, তাই পাসপোর্ট অফিস কর্তৃপক্ষের দায় ছিল কম; কিন্তু এখন সেটা না থাকায় পাসপোর্টের আবেদনকারীকে ভালো মতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। যদি কেউ অবৈধভাবে অতীতে পাসপোর্ট বানিয়ে থাকে তাহলে তথ্য-প্রমাণ পেলে অবশ্যই তড়িৎ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

প্রতারণা ও পরিচয়পত্র জালিয়াতির অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে পাসপোর্টে থাকা তৈয়বার সাথে জরুরি যোগাযোগের নম্বরে ফোন দেওয়া হলে অপর প্রান্ত থেকে ‘ভুল নম্বর’ জানিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন অজ্ঞাত এক নারী

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য

দৈনিক বাংলাদেশের চিত্র একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল। এই পত্রিকার মূল স্লোগান হলো "সত্য প্রকাশে আপোষহীন"।আমরা এ দেশের নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের কথা বলি।একজন অসহায় মানুষের পাশে দাড়িয়ে অন্যায় প্রতিরোধে সাহায্য করতে আমরা সর্বদা অঙ্গীকারবদ্ধ।দৈনিক বাংলাদেশের চিত্র পত্রিকা গনমানুষের কথা বলে।
ট্যাগস :

রোহিঙ্গা সুন্দরী তৈয়বার মালয়েশিয়ায় ‘বিয়ে বাণিজ্য’

আপডেট সময় : ০২:১৮:২৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

১৯৯৭ সালে মিয়ানমারের মংডু থেকে পালিয়ে এসে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয় রোহিঙ্গা নারী সুরুজ জামানের পরিবার।

সুরুজের প্রথম সন্তান তৈয়বা আক্তার অবৈধ উপায়ে তৈরি করেছেন বাংলাদেশি পাসপোর্ট। আর সেই পাসপোর্টে তিনি নিয়মিত অবাধে মালয়েশিয়া যাতায়াত করছেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিসহ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তৈয়বার রয়েছে একাধিক স্বামী। এছাড়াও বিয়ের নামে অভিনব প্রতারণার ফাঁদে ফেলে অসংখ্য বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা যুবককে তিনি করেছেন নিঃস্ব।

কে এই তৈয়বা?
উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ‘রোহিঙ্গা সুন্দরী মালয়েশিয়ান তৈয়বা’ নামে ব্যাপক আলোচিত এই নারী। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য প্রদত্ত এমআরসি কার্ড (শরণার্থী পারিবারিক প্রত্যায়ন পত্র) এর তথ্যানুযায়ী উখিয়ার কুতুপালং নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের (কুতুপালং আরসি) বি-ব্লকের বাসিন্দা। এমআরসি নং- ১৮৫৭০ ক্রমিকের কার্ডটির তথ্য বলছে, ওই ব্লকের ৪১নং শেডে বাস করা তৈয়বা আক্তারের জন্ম ১৯৯৪ সালের ১ জানুয়ারি। এছাড়া কার্ডটিতে তৈয়বার মা সুরুজ জামান ও ভাই নুরুল আফসারসহ পরিবারের ৫ সদস্যের তথ্য রয়েছে।

ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৬ বছর আগে মালেয়শিয়া প্রবাসী এক রোহিঙ্গা যুবকের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে কুয়ালালামপুরে পাড়ি জমান তৈয়বা। সেই যুবকের সাথে বিচ্ছেদের পর অন্তত ৬ জনকে তিনি বিয়ে করেছেন। এছাড়াও প্রেমের সম্পর্ক গড়ে বিয়ের আশ্বাসে আরও ৭/৮ জন যুবকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল অংকের অর্থ।

তৈয়বার এক প্রতিবেশী বলেন, সে মালয়েশিয়ায় থাকে মাস ছয়েক। এরপর এখানে বেড়াতে আসে। সেখানে এক ছেলে তাকে বিয়ে করে নিয়ে গিয়েছিল, পরে শুনেছি তাদের বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। এখন নাকি নতুন বিয়ে করেছে। তবে তার আসল স্বামীকে আমরা চিনি না, সে খুব বিলাসি চলাফেরা করে।

রোহিঙ্গা হয়েও কিভাবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট পেলেন তৈয়বা?
এই নারীর বর্তমান ব্যবহৃত বাংলাদেশি পাসপোর্ট নম্বর হচ্ছে – ইএম০১৮..

…। ২০২৩ সালের ২০ নভেম্বর ইস্যুকৃত সেই পাসপোর্টের তথ্যানুযায়ী, তৈয়বার ঠিকানা নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলার ভূঁইয়ারহাটের চন্দ্রসুদ্দি গ্রামে। পাসপোর্টে বাবার নাম লেখা হয়েছে বাবুল মিয়া ও তার আসল মা সুরুজ জামান হলেও মায়ের নাম লেখা আছে আমেনা খাতুন। এছাড়াও স্বামীর নামের স্থলে আছে দাদন মিয়া এবং জরুরি যোগাযোগের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে – ৩৬ পুরানা পল্টন, ঢাকা জিপিও, পল্টন, ঢাকা। এমআরসি কার্ডের সাথে প্রায় ৫ বছর ব্যবধান রেখে পাসপোর্টে জন্ম তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ১০ মার্চ ১৯……. এবং প্রদত্ত জন্ম নিবন্ধন নং- ১৯৯৯১৯২০………..।

বাস্তবে তৈয়বার এই পরিচয় সম্পূর্ণ ভূয়া বলে তার মূল ঠিকানা কুতুপালংয়ে নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। পাশাপাশি এমআরসি কার্ডে প্রদত্ত ছবি ও পাসপোর্টের ছবির মধ্যে তৈয়বার মুখমণ্ডলের যথেষ্ট মিল পরিলক্ষিত হয়েছে। এছাড়াও প্রতিবেদকের হাতে তৈয়বার ব্যবহৃত আরও একটি পুরাতন পাসপোর্ট (ইবি০৫১২…) এর স্ক্যান কপি সংরক্ষিত আছে।

১৯৭৩ এর পাসপোর্ট আইন অনুযায়ী, শুধুমাত্র বাংলাদেশের নাগরিকরাই বৈধভাবে পাসপোর্ট পেতে পারেন এবং বিদেশি বা শরণার্থী (যেমন রোহিঙ্গা) কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশি পাসপোর্ট পাওয়ার যোগ্য নন। আইনের ১১নং ধারায় বলা আছে, ভুয়া তথ্য দিয়ে বা মিথ্যা পরিচয় দিয়ে পাসপোর্ট নেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যার শাস্তি সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানা, অথবা উভয়ই হতে পারে।

রোহিঙ্গা যুবক আতিকের ২০ লাখ টাকা আত্মসাৎ
২ বছর আগে মুঠোফোনে তৈয়বার পরিচয় ঘটে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ২৫ বছর বয়সী তরুণ মোহাম্মদ আতিকের সাথে। নিয়মিত যোগাযোগের মধ্যে তৈরি হয় প্রেমের সম্পর্ক। আতিককে বিয়ে করে মালয়েশিয়া নিয়ে যাবেন জানিয়ে বিভিন্ন সময় তার কাছ থেকে তৈয়বা হাতিয়ে নেন টাকা। একপর্যায়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তৈয়বা। নিজের সবটুকু হারিয়ে নিঃস্ব আতিক জানতে পারেন এই নারী একজন প্রতারক।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি তাকে বিশ্বাস করে ভালোবেসেছি, যখন যা চেয়েছে দিয়েছি। সে আমার কাছ থেকে কমপক্ষে ২০ লাখ টাকা নিয়েছে। অনেক স্বপ্ন ছিল সংসার করবো মালয়েশিয়ায় নতুন জীবন গড়বো। কিন্তু সে একটা প্রতারক বলে পরে জানতে পেরেছি। দুই মাস আগে বাংলাদেশে সে এসেছে শুনে অনেক চেষ্টা করেও টাকা ফেরত পাইনি।

আতিক দাবি করেন, মালয়েশিয়ায় তার অনেক স্বামী আছে। সে কিছুদিন পর আবারও সেখানে চলে যাবে। আমার মতো অনেকের সাথে একই কাজ করেছে এবং করতে থাকবে কারণ এটা তার পেশা। আল্লাহ তার বিচার করবে।

মালয়েশিয়ায় ‘অবৈধ’ বিয়ে বাণিজ্য
বিয়ের নামে প্রতারণায় সিদ্ধহস্ত রোহিঙ্গা তরুণী তৈয়বার হাতে প্রতারিত আতিক ছাড়াও আরও কয়েকজন ভুক্তভোগী তরুণের অভিযোগ মিলেছে যারা মালয়েশিয়ায় বাস করেন। প্রতারিতদের মধ্যে রোহিঙ্গা ছাড়াও আছেন বাংলাদেশি, কানাডিয়ান ও পাকিস্তানি নাগরিক।

২০১৯ সালের শেষের দিকে রোহিঙ্গা যুবক সালামতউল্লাহর সাথে পরিচয়ের পর ধর্মীয়ভাবে তৈয়বার বিয়ে হয়। কুয়ালালামপুরের শহরতলীতে সবজি-ফল এর দোকান নিয়ে ভালোই জীবন যাচ্ছিল সালামতের। কিন্তু তৈয়বার ফাঁদে পড়ে হারাতে হয় ব্যবসা থেকে শুরু করে কষ্টার্জিত সব অর্থ।

সালামত উল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, পরিবারের জন্য পাঠাতে হবে, জমি কিনতে হবে মিথ্যা তালবাহানা করে মাত্র ১ বছরের সংসার জীবনে সে আমার ৩০ লাখ টাকার বেশি ক্ষতি করেছে। আমি বিশ্বাস করে ঠকেছি, সব হারিয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছি। কানাডা প্রবাসী রহিমউল্লাহ নামে এক রোহিঙ্গা যুবককে মালয়েশিয়ায় বিয়ের কথা বলে নিয়ে আসেন তৈয়বা।

রহিমউল্লাহর এক বন্ধু বলেন, তৈয়বার প্রলোভনে পড়ে রহিমউল্লাহ স্ত্রী-সন্তান ছেড়ে মালেয়শিয়া গিয়েছিলেন। হোটেলে অবৈধভাবে অবস্থান করে রহিমের ভিডিও ধারণ করে তৈয়বা তাকে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকলে সে বিপুল টাকা দিয়ে কানাডা ফিরে যায়। একই কাজ এক পাকিস্তানির সাথেও করেছে বলে শুনেছি। এছাড়াও অনুসন্ধানে মেহেদী নামে এক বাংলাদেশি তরুণের তথ্য পাওয়া গেছে যিনিও তৈয়বার হাতে একইভাবে প্রতারণার শিকার হয়েছেন।

মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ী আমিনুল হাকিম বলেন, অবৈধভাবে বিয়ে বাণিজ্য করে অসংখ্য যুবক ভাইদের তৈয়বা নামের রোহিঙ্গা নারী মালয়েশিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণা করে বেড়াচ্ছে। সে খুব চতুর, অপকর্মে ঢাকতে এখানে বারবার স্থান পরিবর্তন করে। তার শাস্তি হওয়া উচিত যেন সে কখনো মালয়েশিয়া আসতে না পারে।

অবৈধ পাসপোর্ট থেকেও কেন অধরা এই রোহিঙ্গা নারী?
ঢাকার উত্তরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে পাসপোর্ট করতে এসে ২০২২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ধরা পড়েন হতিজা আক্তার নামে এক রোহিঙ্গা নারী। হতিজা ওই সময় পাসপোর্ট কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছিলেন, মালয়েশিয়ায় অবস্থানকারী এক ছেলের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। ওই ছেলের পরামর্শে পাসপোর্ট তৈরি করে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পরিকল্পনা করেন তিনি। গত ২৭ আগস্ট ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে পাসপোর্ট করতে এসে ধরা পড়েন এক রোহিঙ্গা নারী।

এনআইডি ও অন্যান্য কাগজপত্র জমা দিলেও শেষ পর্যন্ত বায়োমেট্রিক যাচাইয়ের সময় তার আসল পরিচয় প্রকাশ পায়। এসময় আটক নারীর স্বামী পরিচয় দেওয়া বাংলাদেশি যুবক মেজবাহকেও আটক করা হয়। এরপর দিন ২৮ আগস্ট চট্টগ্রামে ভুয়া তথ্য ব্যবহার করে পাসপোর্ট করতে যাওয়া দুই রোহিঙ্গা নাগরিককে আটক করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

পাসপোর্ট করতে গিয়ে এসব রোহিঙ্গারা ধরা পড়লেও অবৈধভাবে পাসপোর্ট বানিয়ে ফেলতে সক্ষম হওয়া তৈয়বারা রয়ে যাচ্ছেন অধরা।

উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মীর সাহেদুল ইসলাম বলেন, বিগত সময় অনেক রোহিঙ্গা পাসপোর্ট ও এনআইডি দালালদের মাধ্যমে মোটা টাকায় বানিয়েছে। এখন সেই সুযোগ আর নেই, আমরা প্রতিটি তথ্য যাচাই করি খুব সুক্ষভাবে। অতীতে এসব অপকর্মে যারা জড়িত ছিল তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত, একই সাথে অবৈধ পাসপোর্টগুলো শনাক্ত করে বাতিল করা উচিত বলে মনে করি।

কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মোবারক হোসেন বলেন, আবেদনকারীদের সন্দেহ হলে তাদের কাগজপত্র যাচাই করতে গিয়ে জালিয়াতি ধরা পড়ে। আর দালালদের দৌরাত্ম অনেকাংশে এখন কমে এসেছে, আমরা এই বিষয়ে সতর্ক আছি।

রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট করার কোনো সুযোগ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, আগে পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রথা চালু ছিল, তাই পাসপোর্ট অফিস কর্তৃপক্ষের দায় ছিল কম; কিন্তু এখন সেটা না থাকায় পাসপোর্টের আবেদনকারীকে ভালো মতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। যদি কেউ অবৈধভাবে অতীতে পাসপোর্ট বানিয়ে থাকে তাহলে তথ্য-প্রমাণ পেলে অবশ্যই তড়িৎ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

প্রতারণা ও পরিচয়পত্র জালিয়াতির অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে পাসপোর্টে থাকা তৈয়বার সাথে জরুরি যোগাযোগের নম্বরে ফোন দেওয়া হলে অপর প্রান্ত থেকে ‘ভুল নম্বর’ জানিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন অজ্ঞাত এক নারী