মোদি ম্যাজিক এবার ম্লান তবে গ্যারান্টিতে খুব বেশি আস্থা রাখতে পারেনি ভারতবাসী

- আপডেট সময় : ১০:৪৩:৫৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৫ জুন ২০২৪ ৯৩ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক : আশরাফ
বুথফেরত জরিপ অনুসারে লোকসভা নির্বাচনে এবারও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার কথা ছিল নরেন্দ্র মোদির বিজেপির। তবে শুরু থেকেই বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের নেতারা দাবি করছিলেন, ওই জরিপের পরিসংখ্যান সঠিক নয়। তাদের দাবি অনেকাংশেই সত্য হয়েছে। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার গঠন করতে পারছে না তা নিশ্চিত। সরকার গঠন করার জন্য দলটিকে তাদের জোটভুক্ত এনডিএর মিত্রদের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। অর্থাৎ একটি ঝুলন্ত পার্লামেন্ট পাচ্ছে ভারত। সেই সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেস ফিরে পাচ্ছে বিরোধী দলের মর্যাদা। গতকাল মঙ্গলবার রাত ১টার দিকে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ভোটগণনার ঘোষিত ফল এমন চিত্রই দিয়েছে।
ভারতের নির্বাচন কমিশনের তথ্যসূত্র মতে, ৫৩৯টি আসনের চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৪০টিতে জয় পেয়েছে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি। ৯৭টি আসনে জয় পেয়েছে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস। অন্য দলগুলোর মধ্যে সমাজবাদী পার্টি (এসপি) ৩৭টি, তৃণমূল কংগ্রেস ২৯টি, দ্রাবিড় মুনেত্র কাজগম (ডিএমকে) ২০টি, আম আদমি পার্টি তিনটিতে জয় পেয়েছে। এছাড়া তেলেগু দেশম পার্টি ১৬টি, শিবসেনা (উদ্ভব) আটটি, শিবসেনা (এসএইচএস) সাতটি, ইনডিপেনডেন্ট (ইএনডি) পার্ট সাতটি, ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি (এনসিপিএসপি) ছয়টি, লোক জনশক্তি পার্টি (এলজেপিআরভি) পাঁচটি, যুবজন শ্রমিক রাইথু কংগ্রেস পার্টি (ওয়াইএসআরসিপি) চারটি, রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি) চারটি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) চারটি, ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লীগ (আইইউএমএল) তিনটি, ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা (জেএমএম) তিনটি, জনসেনা পার্টি (জেএনপি) দুটি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) দুটি, জনতা দল (ধর্মনিরপেক্ষ) দুটি, বিদুথালাই চিরুথাইগাল কাচি (ভিসিকে) দুটি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই) দুটি, রাষ্ট্রীয় লোকদল (আরএলডি) দুটি এবং জম্মু ও কাশ্মির জাতীয় সম্মেলন (জেকেএন) দুটি আসনে জয় পেয়েছে। একটি করে আসনে জয় পেয়েছে ইউনাইটেড পিপলস পার্টি, লিবারেল (ইউপিপিএল), অসম গণপরিষদ (এজিপি), হিন্দুস্তানি আওয়ামী মোর্চা (ধর্মনিরপেক্ষ), কেরালা কংগ্রেস (কেইসি), বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল (আরএসপি), জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস পার্টি (এনসিপি), ভয়েস অব দ্য পিপল পার্টি, জোরাম পিপলস মুভমেন্ট (জেপিএম), শিরোমনি আকালি দল (এসএডি), রাষ্ট্রীয় লোকতান্ত্রিক পার্টি (আরএলটিপি), ভারত আদিবাসী পার্টি, সিকিম ক্রান্তিকারী মোর্চা (এসকেএম), মারুমালারচি দ্রাবিড় মুনেত্র কাজগম (এমডিএমকে), আজাদ সমাজ পার্টি (এএসপিকেআর), আপনা দল (সোনিলাল), আজসু পার্টি (আজসুপ) এবং অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন পার্টি। এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্বাচনে এনডিএ জোট পেয়েছে ২৯৪টি আসন আর ইন্ডিয়া জোট জয় পেয়েছে ২৩১টি আসন। সরকার গঠন করতে প্রয়োজন হবে ২৭২টি আসন।এই লোকসভা নির্বাচন জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেস তার প্রাসঙ্গিকতা ফিরিয়ে এনেছে। বিরোধী দলনেতার পদের জন্য লোকসভায় ৫৫টি আসনে জেতা প্রয়োজন। কিন্তু ২০১৪-এ ৪৪ এবং ২০১৯-এ ৫২টি আসনে জেতা কংগ্রেস সংসদীয় বিধি অনুযায়ী সেই মর্যাদা পায়নি। সবশেষ প্রাপ্ত ফল অনুসারে ৯৯টি আসনে জয় পেয়েছে মল্লিকার্জুন খাড়গের দল।
উত্তর প্রদেশ প্রায় হাতছাড়া বিজেপির!
বিজেপির উত্থানকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত উত্তর প্রদেশে দলটি সবচেয়ে বড় চমকের সম্মুখীন হয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে উত্তর প্রদেশে দলটি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে টিকে রয়েছে। ২০১৯ সালে এই রাজ্যের ৮০টি আসনে বিজেপি একাই ৬২টিতে জয়ী হয়। সেবার কংগ্রেস মাত্র একটি আসনে জয় পেয়েছিল। কিন্তু এবারের নির্বাচনে বড় চমক দেখিয়েছে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোট। ৮০টি আসনের মধ্যে প্রায় ৪৫টিতে এগিয়ে আছে ইন্ডিয়া জোট। ইতোমধ্যে রাহুল গান্ধী কেরালা ওয়েনাডে জয় পেয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটের তথ্য, এই আসনে রাহুল পেয়েছেন ৬ লাখ ৪৭ হাজার ৪৪৫ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার (সিপিআই) প্রার্থী অ্যানি রাজা পেয়েছেন ২ লাখ ৮৩ হাজার ২৩ ভোট। রাহুল উত্তর প্রদেশের রায়বেরেলি থেকেও নির্বাচন করেছেন। তবে এই আসনের চূড়ান্ত ফল এখনও ঘোষণা করা হয়নি। তবে এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুসারে, এই আসনেও রাহুলই বিজয়ী হতে চলেছেন।
পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের নিরঙ্কুশ জয়
লোকসভা নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জি নেতৃত্বাধীন সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস ইন্ডিয়া জোটের হয়ে অংশগ্রহণ করেনি। পশ্চিমবঙ্গের লোকসভার ৪১টি আসনের মধ্যে ৩টির চূড়ান্ত ফল প্রকাশ হয়েছে। তিনটিতেই জয়ী হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। এর মধ্যে ডায়মন্ড হারবার আসনে জিতেছেন তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। আসানসোলে জয় পেয়েছেন শত্রুঘ্ন সিনহা। আর বর্ধমান-দুর্গাপুর আসনে জিতেছেন কীর্তি আজাদ ঝা। এছাড়া ২৬টি আসনে এগিয়ে রয়েছে মমতার দল। অন্যদিকে বাকি আসনগুলোর মধ্যে ১২টিতে এগিয়ে বিজেপি।
মহারাষ্ট্রে বিজেপির বড় ধস
মহারাষ্ট্রেও বড় চমকের মুখোমুখি হয়েছে বিজেপি। রাজ্যের ৪২টি আসনের মধ্যে ইন্ডিয়া জোটভুক্ত কংগ্রেস, শিবসেনা (ইউবিটি) এবং ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি ২৭টি আসনে এগিয়ে রয়েছে। ২৭টির মধ্যে ১০টিতে এগিয়ে কংগ্রেস। নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, বিজেপি ১৪টি আসনে এগিয়ে রয়েছে। বিগত দিনে শিবসেনার সঙ্গে বিজেপি জোট গঠন করে মহারাষ্ট্রে নির্বাচন করলেও পাঁচ বছর আগে তাদের জোট ভেঙে যায়। শিবসেনার সঙ্গে বিজেপির সম্পর্কের অবনতির কারণেই মহারাষ্ট্রে বিজেপি পিছিয়ে পড়েছে বলে অভিমত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।
কর্ণাটকে কোনোমতে টিকে আছে বিজেপি
২০১৯ সালে কর্ণাটকের ২৮টি আসনের ২৫টি বাগিয়ে নেয় বিজেপি। সেবার কংগ্রেস মাত্র একটি আসন পায়। এবারও কর্ণাটকে বিজেপিই জয়ী দল হিসেবে আবির্ভূত হতে চলেছে। তবে ২০১৯ সালের মতো বড় মার্জিনে তারা জয়ী হচ্ছে না। ভারতের নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, কর্ণাটকে বিজেপি ভোটগণনায় ১৬টি আসনে এগিয়ে রয়েছে।
ত্রিপুরায় বিজেপিই সংখ্যাগরিষ্ঠ
পূর্ব ত্রিপুরায় বিজেপির কৃতী দেবি দেববর্মা ৭ লাখ ৭৭ হাজার ৪৪৭ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। কৃতীকে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে বিজেপির রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। দেববর্মা রাজনৈতিক পরিবার বহুদিন ধরেই ত্রিপুরার সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। মূলত রাজনৈতিক চাল হিসেবেই তাকে বিজেপির মনোনয়ন দেওয়া হয়।
আঞ্চলিক শক্তির উত্থান
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভারতের রাজনৈতিক বিন্যাসে বড় পরিবর্তন এসেছে। দেশটির বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো প্রভাব বিস্তার করেছে। মিজোরামে জোরাম পিপলস মুভমেন্ট (জেপিএম) এবং সিকিমে সিকিম ক্রান্তিকারী মোর্চার জয় তা-ই ইঙ্গিত করে। দুটি দলই তাদের নির্বাচনী এলাকায় জয়ী হয়েছে। জেপিএম, এনডিএ কিংবা ইন্ডিয়া জোটভুক্ত দল নয়। তারা এবার বিজেপি ও কংগ্রেসের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হয়েছে।
নীতিশ-নাইডুর সঙ্গে যোগাযোগ করছে কংগ্রেস
লোকসভা নির্বাচনে বেশ কয়েকটি অঞ্চলে ক্ষমতাসীন বিজেপির আসন কেড়ে নিয়েছে কংগ্রেস। ক্ষমতাসীন বিজেপির এনডিএ জোটের চেয়ে ৫০টির মতো আসনে পিছিয়ে রয়েছে তারা। এমন পরিস্থিতিতে এনডিএ জোটের ভেতরে-বাইরের বেশ কয়েক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে কংগ্রেস। হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এনডিএ জোটের শরিক অন্ধ্র প্রদেশের তেলেগু দেশম পার্টির (টিডিপি) প্রধান চন্দ্রবাবু নাইডু এবং বিহারের জনতা দল ইউনাইটেডের (জেডি-ইউ) প্রধান নীতিশ কুমারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন কংগ্রেস প্রধান মল্লিকার্জুন খাগড়ে।