ঠাকুরগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উন্নয়ন বরাদ্দের অর্থে দূর্নীতি

- আপডেট সময় : ০৩:২৭:২৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ৭ এপ্রিল ২০২৫ ১৫ বার পড়া হয়েছে

মোঃ খায়রুল ইসলাম:-ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উন্নয়ন বরাদ্দের অর্থে দূর্নীতির আশ্রয় নিয়ে পাঠাগার গড়ার নামে বিতর্কিত ও শিশুদের পড়ার অনুপযোগী গল্পের বই ও উপকরণ বিদ্যালয়ে পৌঁছে দিচ্ছে একটি মহল।
প্রায় ১ কোটি সরকারি বরাদ্দের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চক্রান্তে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ৪০৭ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিটিতে এসব গল্পের বই পৌঁছে দিতে মেতে উঠেছে চিহ্নিত একটি মহল
বলে অভিযোগ উঠেছে।
সম্প্রতি দূর্নীতি দমন কমিশন সহ বিভিন্ন দপ্তরে জনৈক শিক্ষকের অভিযোগের পর দূর্নীতির বিষয়টি সামনে আসে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কতিপয় প্রধান শিক্ষক জানান, কয়দিন পূর্বে ‘বালিয়াডাঙ্গী খেলা ঘর এর স্বত্ত্বাধিকারী মাসুদ হাসান ও শফিউল ইসলাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যাালয়ের প্রধান শিক্ষক গোলাম ফারুক এবং বাকুন্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক এস.কে মানিক শামিম কিছু বিদ্যালয়ে এ সকল গল্পের বই ও উপকরণ প্রথমে পৌঁছে দিলে ও অভিযোগ হওয়ার পরে তাঁরা আর সরাসরি এসব গল্পের বই ও উপকরণ পৌঁছে দিচ্ছেন না। বর্তমানে চক্রটির সহায়তায় প্রতিটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের নামে সরাসরি ঢাকা থেকে কুরিয়ার সার্ভিস যোগে গল্পের বই পৌঁছে যাচ্ছে কাঙ্খিত ঠিকানায়
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ৪০৭ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিটিতে ১৫ হাজার টাকার গল্পের বই এবং সাড়ে ৩ হাজার টাকার শিক্ষা উপকরণ নিতে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের বাধ্য করে প্রাথমিক শিক্ষার সাথে জড়িত মহলটি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রাথমিক শিক্ষার বিদ্যালয় উন্নয়ন বরাদ্দের অর্থ উত্তোলনের পূর্বেই এ চক্রটি প্রায় কোটি টাকার বাণিজ্য টার্গেট করে
এসব গল্পের বই আর শিক্ষা উপকরণ কৌশলে বিদ্যালয়ে বিদ্যালয়ে পৌঁছে দিচ্ছে।
যে সব বই যাচ্ছে স্কুলে স্কুলে: একটি সূত্র জানায়, ভিশন পাবলিকেশন্স-এর সাথে চুক্তিবদ্ধ হবার সাথে সাথে বিদ্যািলয়ের জন্য এ একটি বইয়ের তালিকা প্রকাশনীটি চক্রটির হাতে তুলে দেয়।
তালিকা টিতে প্রতিটি বইয়ের দাম ২শত টাকা থেকে ১ হাজার ৪০০ শত ৫০ টাকা পর্যন্ত দেখানো হয়। সব মিলিয়ে বিভিন্ন আইটেমের বইয়ের দাম সর্বমোট ২৫ হাজার টাকা উল্লেখ করা হলেও শতকরা ৪০ ভাগ কমিশন দেখিয়ে ১৫ হাজার টাকা পরিশোধ মূল্যে দেখানো হয় ঐ ভাউচারে।
বইয়ের সাথে এ ভাউচারটি প্রতিটি বিদ্যালয়ের পাঠানো হয়। আর এ ভাউচারটি ব্যবহার করে প্রধান শিক্ষকগণ ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রাথমিক শিক্ষার বিদ্যালয় উন্নয়ন বরাদ্দ (স্লিপ ফান্ড) থেকে বিল প্রস্তুত করে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের মাধ্যোমে টাকা উত্তোলন করে সহকারী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার কিংবা শিক্ষক নেতৃবৃন্দের হাতে তুলে দেওয়ার কথা।
প্রধান শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগ করে বিদ্যালয়ের গিয়ে দেখা গেছে, পাঠানো বইয়ের মধ্যে জাফর ইকবালের তবুও টুনটুনি’, হুমায়ুন আহমেদ-এর ‘একজন হিমু, নিশিকাব্যা’, অদ্বৈত মল্ল বর্মন-এর ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, যাযাবর-এর ‘দৃষ্টিপাত’, বিভূতিভূষণ বন্দ্যো পাধ্যায়-এর ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’, ‘অসনি সংকেত’, প্রবীর ঘোষ-এর ‘মনের নিয়ন্ত্রণে যোগ মেডিটেশন’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর ‘বিসর্জন’, ‘সোনার তরী’, ‘গীতাঞ্জলি’, মানিক বন্দ্যো পাধ্যােয়-এর ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, ডা. রমেন মজুমদার-এর ‘ডায়াবেটিস-এ সব খাবেন’, ড. লুৎফর রহমান-এর ‘ধর্ম জীবন, ‘মানব জীবন’, ‘মহা জীবন’, হারুন-অর-রশীদ-এর ‘এই আমাদের বাংলাদেশ’, ছোটদের জগদিশ চন্দ্র বসু’, ‘ছোটদের সুভাস চন্দ্র বসু’, ডা. শ্যা মল চক্রবর্তীর ‘কোন অসুখে কী খাবেন,ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ।
ভিশন পাবলিকেশন্স-এর সরবরাহকৃত তালিকাটিতে মোট ৫২টি বইয়ের নাম উল্লেখ করা হয়। অনেক শিক্ষক বলছেন, “সরবরাহকৃত এ সব বইয়ের অধিকাংশ বিগত আওয়ামী দোসরদের লেখা এবং প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের পড়ার জন্য উপযোগী নয়- শুধু সরকারি অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়, আমরা নিরূপায় ।
কী ভাবে ব্যবসার টার্গেট নেওয়া হয়: প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বিদ্যালয় উন্নয়ন পরিকল্পনা (স্লিপ) এ প্রতি বছরের ন্যায় ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে প্রতিটি বিদ্যালয়ে ন্যূনতম ৭০ হাজার ৫০০ শত ৬ টাকার বরাদ্দ পায়। এ অর্থ পেতে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সহ স্লিপ প্রণয়ন কমিটি বিদ্যালয়ের বিপরীতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে অনলাইনে একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা দাখিল করতে হয়।
এ অর্থ দিয়ে বিদ্যালয়ের কী কী উন্নয়ন কাজ করা হবে- তা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ‘আইপেমিস’ সফ্টওয়্যা,রে সাবমিট করার পর সহকারী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার(এইউপিইও) কে অনুমোদন করতে হয়।
এ সুযোগে সে সময় ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে সিনিয়র সহকারী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোকাদ্দেস ইবনে সালাম, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের দায়িত্বে থাকাবস্থায় প্রধান শিক্ষকদের মাসিক সমন্বয় সভায় মৌখিকভাবে প্রধান শিক্ষকদের বিদ্যালয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় লাইব্রেরী স্থাপনের নির্দেশনা প্রদান করেন।
এরই প্রেক্ষিতে প্রধান শিক্ষকগণ বিদ্যালয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় লাইব্রেরী স্থাপনের বিষয়টি অনলাইনে অন্তর্ভূক্ত করতে বাধ্য হন। এদিকে সহকারী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার সৈয়দ মোকাদ্দেস ইবনে সালাম, ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে কর্মরত অপরাপর সহকারী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারবৃন্দকে ম্যানেজ করে প্রতিটি বিদ্যালয়ের গল্পের বই সরবরাহের বিষয়টি হাতে নিয়ে ভিশন পাবলিকেশন্স’ নামে একটি প্রকাশনীর সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। সাথে সাথে প্রকাশনীটি তাঁদের হাতে একটি বইয়ের তালিকা ধরিয়ে দেয়। বইয়ের তালিকাটি প্রকাশ হবার সাথে সাথেই ঠাকুরগাঁও সদরে শিক্ষকদের মাঝে হইচই শুরু হয়।