ঢাকা ০২:৩৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৫, ১৫ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
বহমান বাংলা পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা বরেণ্য শিক্ষাবিদ মো. জিয়াউর রহমান’র ওফাতে গভীর শোক প্রকাশ সাতক্ষীরা-৪ (শ্যামনগর) আসনে এবি পার্টির আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচারণা শুরু সাতক্ষীরা জেলা ব্যাপি ঔষধের দোকান বন্ধ রেখে ধর্মঘট সফল করার লক্ষ্যে প্রস্তুতি সভা শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে সাংবাদিকদের মত বিনিময় সভা অনুষ্ঠিত সাপলেজা বাজার বা হাট ভুমি দস্যুদের হিংস্র থাবায় স্হাপনা তৈরী করে বেহাল দশা ঐতিহ্য বাহী জমিদার বাড়ী আজ ময়লা আবর্জনায় পরিত্যাক্ত পরিবেশ দুষনের হুমকি সৈয়দপুর সরকারি কলেজে গ্রীন ভয়েসের বৃক্ষ বিতরণ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত চাকরি ছাড়ায় মিথ্যা মামলা ম্যানেজারের বিরুদ্ধে ঝিনাইদহের ব্যবসায়ী লালু ও তার ছেলে সৌরভের বিরুদ্ধে নকল মোবাইল বিক্রির অভিযোগ রাজাপুরে (পিএফজি)-এর জেন্ডার সচেতনতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ ও ত্রৈমাসিক সভা অনুষ্ঠিত নোবিপ্রবি সাহিত্য সংগঠন “শব্দকুটির” এর নতুন নেতৃত্বে নাঈম ও অর্পিতা

নৌকূটনীতির জিরাফ: বাংলার নৌশক্তি ও মিং চীনের কূটনৈতিক বন্ধন

নিজেস্ব প্রতিনিধি
  • আপডেট সময় : ০৭:৪৪:১৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫ ৬০ বার পড়া হয়েছে

মো. শফিউল্লাহ, নোবিপ্রবি প্রতিনিধি:
১৪শ শতকের শেষ দিকে বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ (শাসনকাল: ১৩৮৯–১৪১০) একাধারে ধর্মপ্রাণ, জ্ঞানপিপাসু ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক সচেতন শাসক ছিলেন। এই সময়ে চীনে ইউংলে সম্রাট (Yongle Emperor) মিং সাম্রাজ্যের শাসক ছিলেন, যিনি বৈদেশিক বাণিজ্য ও কূটনীতির বিস্তার ঘটাতে উদ্যোগী হন। এই দুই শাসকের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তা শুধু বন্ধুত্বপূর্ণ দূতাবিনিময়েই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং বাংলা হয়ে ওঠেছিল চীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অংশীদার।

সেই সময়ে চীনের সম্রাটের দরবারে বাংলার সুলতানের পাঠানো এক জিরাফ ইতিহাসের পাতায় স্থান দখল করে আছে যা শুধু কৌতূহলের কারণে নয়, বরং এটি ছিল বাংলার গৌরবময় নৌশক্তি ও কূটনৈতিক প্রজ্ঞার এক উজ্জ্বল নিদর্শন। সুলতানের দূতাবিনিময় ও উপহার প্রেরণ প্রমাণ করে যে, বাংলা শুধু আঞ্চলিক শক্তিই ছিল না, বরং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করত।

জিরাফের আগমন ও ইতিহাস:
১৪১৪ খ্রিস্টাব্দে চীনের রাজদরবারে পৌঁছায় এক অদ্ভুতদর্শন প্রাণী জিরাফ।সুলতানের নির্দেশে পূর্ব আফ্রিকার মালিন্দি অঞ্চল থেকে বাংলার সমুদ্রবন্দর হয়ে চীনে পৌঁছায় এ প্রাণী । বাংলার সুলতান এই প্রাণীটিকে চীনা সম্রাটের জন্য উপহার হিসেবে পাঠান। ঐতিহাসিক দলিল “মিং শি”-তে এই ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। জিরাফটিকে চীনারা ‘কিরিন’ নামে অভিহিত করে যা এক পৌরাণিক শুভ প্রতীক, যার আবির্ভাব ঘটে শান্তি ও ন্যায়ের যুগে।

চীনা সম্রাট ইউংলে জিরাফ দেখে অভিভূত হয়ে বলেন, “এটি আমার শাসনামলের সৌভাগ্যের চিহ্ন।” এমনকি রাজদরবারে একে প্রদর্শন করে রাজত্বের সাফল্যের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

নৌশক্তি ও বাংলার বিশ্বমঞ্চে উত্তরণ:
এই ঘটনাটি এক অর্থে বাংলার ইতিহাসে একটি মাইলফলক। কারণ, এ সময়কার বাংলা শুধু কৃষিনির্ভর বা স্থলকেন্দ্রিক ছিল না—বাংলা তখন সমৃদ্ধ নৌবন্দর, দক্ষ নাবিক ও প্রগতিশীল বাণিজ্যনীতির মাধ্যমে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক যোগাযোগের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। চট্টগ্রাম, সোনারগাঁও কিংবা সাতগাঁও ছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র।

চীনের সম্রাট ইউংলে তখন বিশাল নৌবাহিনী পাঠাচ্ছিলেন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। সেই অভিযাত্রী ছিলেন বিখ্যাত ঝেং হে, যিনি বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলো সফর করেন। বাংলাও সেই ভ্রমণের এক গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য ছিল।

কূটনৈতিক দূরদর্শিতা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়:
জিরাফ উপহার দেওয়া ছিল শুধু চমক প্রদর্শন নয়, বরং রাজনৈতিক কৌশল ও বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠার এক স্মারক। চীন যেমন বাংলা থেকে পশু, মসলা ও অন্যান্য পণ্য পেয়েছিল; তেমনি বাংলাও চীন থেকে পেয়েছিল মূল্যবান সিল্ক, চিনামাটির বাসন ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান। এই আদান-প্রদান কেবল পণ্য নয়—সঙ্গে এনেছিল অভিজ্ঞতা, ভাষা, রীতিনীতি ও শাসনব্যবস্থার বিনিময়। বাংলা ও চীনের এই সম্পর্ক প্রমাণ করে যে, মধ্যযুগেও বাংলার শাসকগণ কেবল ধর্ম বা যুদ্ধেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না; তাঁরা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নৌবাণিজ্যের সূক্ষ্ম শিল্পেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত।

আজকের বৈশ্বিক দুনিয়ায় আমরা যখন বাণিজ্য, কূটনীতি ও সংযোগের কথা বলি, তখন আমাদের ইতিহাসে ফিরে তাকানো জরুরি। একসময় এই বঙ্গভূমি ছিল বৈশ্বিক যোগাযোগের মহাসড়ক। জিরাফ প্রেরণের ঘটনাটি শুধু একটি কৌতূহলোদ্দীপক ঐতিহাসিক ঘটনা নয় — এটি বাংলার নৌ শক্তি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও কূটনীতির প্রমাণ। মিং চীনের মতো একটি বৃহৎ সাম্রাজ্যের সঙ্গে দূতাবিনিময় করতে পারা এই নৌমাধ্যমেই সম্ভব হয়েছিল।

আমাদের উচিত, সেই ঐতিহ্যকে নতুনভাবে চিনে নেওয়া এবং সমুদ্রনির্ভর সম্ভাবনাকে আবারও আবিষ্কার করা। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা ও সমুদ্রসম্পদের যথাযথ ব্যবহার ও ব্যাবস্থাপনাই পারে বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক, ভূরাজনৈতিক, সামরিক ক্ষেত্রে নতুন এক দিগন্তের উন্মেষ ঘটাতে।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য

দৈনিক বাংলাদেশের চিত্র একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল। এই পত্রিকার মূল স্লোগান হলো "সত্য প্রকাশে আপোষহীন"।আমরা এ দেশের নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের কথা বলি।একজন অসহায় মানুষের পাশে দাড়িয়ে অন্যায় প্রতিরোধে সাহায্য করতে আমরা সর্বদা অঙ্গীকারবদ্ধ।দৈনিক বাংলাদেশের চিত্র পত্রিকা গনমানুষের কথা বলে।
ট্যাগস :

নৌকূটনীতির জিরাফ: বাংলার নৌশক্তি ও মিং চীনের কূটনৈতিক বন্ধন

আপডেট সময় : ০৭:৪৪:১৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫

মো. শফিউল্লাহ, নোবিপ্রবি প্রতিনিধি:
১৪শ শতকের শেষ দিকে বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ (শাসনকাল: ১৩৮৯–১৪১০) একাধারে ধর্মপ্রাণ, জ্ঞানপিপাসু ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক সচেতন শাসক ছিলেন। এই সময়ে চীনে ইউংলে সম্রাট (Yongle Emperor) মিং সাম্রাজ্যের শাসক ছিলেন, যিনি বৈদেশিক বাণিজ্য ও কূটনীতির বিস্তার ঘটাতে উদ্যোগী হন। এই দুই শাসকের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তা শুধু বন্ধুত্বপূর্ণ দূতাবিনিময়েই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং বাংলা হয়ে ওঠেছিল চীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অংশীদার।

সেই সময়ে চীনের সম্রাটের দরবারে বাংলার সুলতানের পাঠানো এক জিরাফ ইতিহাসের পাতায় স্থান দখল করে আছে যা শুধু কৌতূহলের কারণে নয়, বরং এটি ছিল বাংলার গৌরবময় নৌশক্তি ও কূটনৈতিক প্রজ্ঞার এক উজ্জ্বল নিদর্শন। সুলতানের দূতাবিনিময় ও উপহার প্রেরণ প্রমাণ করে যে, বাংলা শুধু আঞ্চলিক শক্তিই ছিল না, বরং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করত।

জিরাফের আগমন ও ইতিহাস:
১৪১৪ খ্রিস্টাব্দে চীনের রাজদরবারে পৌঁছায় এক অদ্ভুতদর্শন প্রাণী জিরাফ।সুলতানের নির্দেশে পূর্ব আফ্রিকার মালিন্দি অঞ্চল থেকে বাংলার সমুদ্রবন্দর হয়ে চীনে পৌঁছায় এ প্রাণী । বাংলার সুলতান এই প্রাণীটিকে চীনা সম্রাটের জন্য উপহার হিসেবে পাঠান। ঐতিহাসিক দলিল “মিং শি”-তে এই ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। জিরাফটিকে চীনারা ‘কিরিন’ নামে অভিহিত করে যা এক পৌরাণিক শুভ প্রতীক, যার আবির্ভাব ঘটে শান্তি ও ন্যায়ের যুগে।

চীনা সম্রাট ইউংলে জিরাফ দেখে অভিভূত হয়ে বলেন, “এটি আমার শাসনামলের সৌভাগ্যের চিহ্ন।” এমনকি রাজদরবারে একে প্রদর্শন করে রাজত্বের সাফল্যের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

নৌশক্তি ও বাংলার বিশ্বমঞ্চে উত্তরণ:
এই ঘটনাটি এক অর্থে বাংলার ইতিহাসে একটি মাইলফলক। কারণ, এ সময়কার বাংলা শুধু কৃষিনির্ভর বা স্থলকেন্দ্রিক ছিল না—বাংলা তখন সমৃদ্ধ নৌবন্দর, দক্ষ নাবিক ও প্রগতিশীল বাণিজ্যনীতির মাধ্যমে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক যোগাযোগের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। চট্টগ্রাম, সোনারগাঁও কিংবা সাতগাঁও ছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র।

চীনের সম্রাট ইউংলে তখন বিশাল নৌবাহিনী পাঠাচ্ছিলেন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। সেই অভিযাত্রী ছিলেন বিখ্যাত ঝেং হে, যিনি বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলো সফর করেন। বাংলাও সেই ভ্রমণের এক গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য ছিল।

কূটনৈতিক দূরদর্শিতা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়:
জিরাফ উপহার দেওয়া ছিল শুধু চমক প্রদর্শন নয়, বরং রাজনৈতিক কৌশল ও বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠার এক স্মারক। চীন যেমন বাংলা থেকে পশু, মসলা ও অন্যান্য পণ্য পেয়েছিল; তেমনি বাংলাও চীন থেকে পেয়েছিল মূল্যবান সিল্ক, চিনামাটির বাসন ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান। এই আদান-প্রদান কেবল পণ্য নয়—সঙ্গে এনেছিল অভিজ্ঞতা, ভাষা, রীতিনীতি ও শাসনব্যবস্থার বিনিময়। বাংলা ও চীনের এই সম্পর্ক প্রমাণ করে যে, মধ্যযুগেও বাংলার শাসকগণ কেবল ধর্ম বা যুদ্ধেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না; তাঁরা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নৌবাণিজ্যের সূক্ষ্ম শিল্পেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত।

আজকের বৈশ্বিক দুনিয়ায় আমরা যখন বাণিজ্য, কূটনীতি ও সংযোগের কথা বলি, তখন আমাদের ইতিহাসে ফিরে তাকানো জরুরি। একসময় এই বঙ্গভূমি ছিল বৈশ্বিক যোগাযোগের মহাসড়ক। জিরাফ প্রেরণের ঘটনাটি শুধু একটি কৌতূহলোদ্দীপক ঐতিহাসিক ঘটনা নয় — এটি বাংলার নৌ শক্তি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও কূটনীতির প্রমাণ। মিং চীনের মতো একটি বৃহৎ সাম্রাজ্যের সঙ্গে দূতাবিনিময় করতে পারা এই নৌমাধ্যমেই সম্ভব হয়েছিল।

আমাদের উচিত, সেই ঐতিহ্যকে নতুনভাবে চিনে নেওয়া এবং সমুদ্রনির্ভর সম্ভাবনাকে আবারও আবিষ্কার করা। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা ও সমুদ্রসম্পদের যথাযথ ব্যবহার ও ব্যাবস্থাপনাই পারে বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক, ভূরাজনৈতিক, সামরিক ক্ষেত্রে নতুন এক দিগন্তের উন্মেষ ঘটাতে।