সোনাগাজী মডেল থানায় ‘চুরি-ডাকাতি’ হয়, মামলা হয় না

- আপডেট সময় : ১২:০৩:৩৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ৪২ বার পড়া হয়েছে

মোহাম্মদ হানিফ,ফেনী জেলা স্টাফ রিপোর্টার:অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসলো এক অজানা কাহিনী। কেন সোনাগাজী উপজেলায় চুরি, ডাকাতি হয় মামলা দায়ের করা হয় না
ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায় চুরি-ডাকাতি হলেও মামলা হয় না থানায়। চুরি-ডাকাতির অভিযোগ নিয়ে থানায় এলেও আসামি অজ্ঞাত থাকায় মামলা করতে অনুৎসাহিত করা হয় থানা থেকে। আবার অনেক ভুক্তভোগী অভিযোগ করলেও তার ফলাফল অগোচরেই থেকে যায়। ভুক্তভোগীরা দাবি করেন, ডাকাতির ঘটনার পর থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশের সিদ্ধান্তে কেবল অভিযোগ করেই বাড়ি ফিরতে হয় কিন্তু তা আর মামলা হিসেবে গ্রহণ করে না সোনাগাজী থানা পুলিশ।
দৈনিক দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে দেখা যায়, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি হতে এপ্রিল মাস পর্যন্ত সোনাগাজী উপজেলার মতিগঞ্জ ইউনিয়নেই ৫টি ডাকাতির অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে ৮ ফেব্রুয়ারি ভোয়াগ গ্রামের রবীন্দ্র কুমার করের বাড়ির চন্দ্রন কুমার করের ঘরে, ২১ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে ভাদাদিয়া গ্রামের আমেরিকা প্রবাসী পলাশের ঘরে, ৭ এপ্রিল দিবাগত রাতে ভোয়াগ গ্রামের বাসিন্দা ও সাবেক উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা হাজী মো. ফিরোজ আলম বাড়িতে, একই রাতে ফিরোজ আলমের প্রতিবেশী চরছান্দিয়ার এক নম্বর ওয়ার্ডের নুরুল আমিনের নতুন বাড়িতে এবং ২১ এপ্রিল কদমতলা এলাকার খালেক ফোরম্যানের নতুন বাড়িতে সৌদি প্রবাসী শেখ বাহার ও ওমান প্রবাসী শেখ আব্দুল ফারুকের ঘরে ডাকাতির ঘটনা ঘটে।
কিন্তু সোনাগাজী মডেল থানায় এবছরের রেকর্ডকৃত মামলার তালিকায় পাওয়া যায়নি একটি ডাকাতির ঘটনাও, নেই দস্যুতার অভিযোগে মামলা। চলতি বছরের জানুয়ারি হতে আগস্ট মাস পর্যন্ত সোনাগাজী থানায় ১৪৪টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে।
এসব মামলার মধ্যে চুরির মামলা ১৪টি, খুনের মামলা ৪টি, ধর্ষণ ৫টি, নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা ১২টি, অস্ত্র আইনে ৪টি, মাদকদ্রব্য ১৮টি এবং অন্যান্য মামলা ৮৪টি।
এই প্রসঙ্গে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চলতি বছরের ২১ এপ্রিল রাত ২টার পর মতিগঞ্জ ইউনিয়নের কদমতলা এলাকার খালেক ফোরম্যানের নতুন বাড়িতে সৌদি প্রবাসী শেখ বাহার ও ওমান প্রবাসী শেখ আব্দুল ফারুকের ঘরে ১০-১৫ জনের ডাকাতদল হানা দেয়। এ সময় লুটপাট চালিয়ে প্রায় ৬ ভরি স্বর্ণালংকার এবং নগদ এক লাখ বিশ হাজার টাকাসহ ১০ লাখ টাকার সমপরিমাণ মালামাল নিয়ে যায়।
ওমান প্রবাসী শেখ আব্দুল ফারুকের স্ত্রী বিবি মরিয়ম রুমা জানান, পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর থানায় লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়। ঘটনার প্রায় ৫ মাস হলে এখনও কোনও মালামাল ও টাকা উদ্ধার হয়নি।
এখন আর এই বিষয়ে পুলিশ আমাদের সঙ্গে কিংবা আমরা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। বাড়িতে কোনও পুরুষ মানুষ নেই, আমরা মহিলা, এর বেশি কি করতে পারি। এখন প্রতিবেশী কেউ এলেও ভয়ে দরজা খুলি না, আগে বারান্দা দিয়ে দেখি তারপর কথা বলি।
ভুক্তভোগীরা জানায়, সেদিন দিবাগত রাত ২টার দিকে ১০-১৫ জনের একটি দল দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাকা ভবনের ছাদ উঠে সিঁড়িঘর দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। এ সময় বাড়ির দুই ইউনিটে কাঠের দরজা ভেঙে ধারালো দেশীয় অস্ত্র দিয়ে সবাইকে জিম্মি করে ফেলে। ওমান প্রবাসী শেখ আব্দুল ফারুকের মা ও স্ত্রী বিবি মরিয়ম রুমার ৫ ভরি স্বর্ণ, নগদ ৫০ হাজার টাকা এবং সৌদি আরব প্রবাসী শেখ বাহারের স্ত্রী নুর নাহারের ৮ আনা ওজনের স্বর্ণের চেইন ও নগদ ৭০ হাজার টাকা নিয়ে যায় ডাকাত।
ভুক্তভোগী বিবি মরিয়ম রুমা বলেন, ডাকাতদল আমার মেয়েদের জিম্মি করে। মেয়েদের ছেড়ে দিতে বলায় তারা আমাকে মেরেছে। পরে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি।
সোনাগাজী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছি। গত ৭ এপ্রিল দিবাগত রাতে মতিগঞ্জ ইউনিয়নের ভোয়াগ গ্রামের বাসিন্দা ও সাবেক উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা হাজী মো. ফিরোজ আলম বাড়িতে ১০-১৫ জনের ডাকাত দল হানা দেয়। সে সময় অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে হাজী মো. ফিরোজ আলমের ঘর থেকে নগদ এক লাখ টাকা ও সাড়ে ৫ ভরি স্বর্ণালংকার লুট করে নেয়।
ভুক্তভোগী হাজী মো. ফিরোজ আলম বলেন, ডাকাতির পর আমরা ৯৯৯-এ ফোন দিলে সেদিন রাত ২টা ৩০ মিনিটের দিকে পুলিশ আসে। পরে পুলিশ আমাদের থানায় যেতে বললে টানা ৩-৪ দিন থানায় গিয়েছি। আজ পর্যন্ত কোনও খোঁজ খবর নেই। থানা থেকে ডাকাত দল শনাক্ত না হওয়ায় আমরা এখনো ভয়ের ভিতরে আছি এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।
ভুক্তভোগী ও সিসিটিভি সূত্রে জানা গেছে, সেই দিন রাত ২টায় সাবেক উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা হাজী মো. ফিরোজ আলমের নতুন বাড়িতে ১০-১৫ জনের একদল ডাকাত হানা দিয়ে দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। একপর্যায়ে বাড়ির সবাইকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে লুটপাট চালায়।
এ প্রসঙ্গে ভুক্তভোগী হাজী মো. ফিরোজ আলম জানান, সিসি ক্যামেরায় ঘটনার পুরো ভিডিও সংরক্ষিত রয়েছে। একই দিন অর্থাৎ, গত ৭ এপ্রিল দিবাগত রাতে হাজী মো. ফিরোজ আলম চরছান্দিয়ার এক নম্বর ওয়ার্ডের নুরুল আমিনের নতুন বাড়িতে ১০-১৫ জনের ডাকাত দল হানা দেয়।
একই সময়ে ডাকাতদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে সোনাগাজী ব্লু ড্রিম ফ্যাশন হাউজের কর্ণধার ও গৃহকর্তা আব্দুল্লাহ আল নোমান আহত হন। ভুক্তভোগী নোমান বলেন, পুলিশ ঘটনার পর রাতেই আমাদের বাড়িতে এসেছিল, পরের দিন আমি থানায় লিখিত অভিযোগ দিলে পুলিশ মামলা নেয়নি, অভিযোগ আকারে নিয়েছে।
মাসের পর মাস চলে যাচ্ছে, এখনো পুলিশ ডাকাতদের শনাক্ত করতে পারেনি। আমি ব্যবসায়ি হিসেবে নিরাপদ নই।
সেদিনের ঘটনা বর্ণনায় নোমান বলেন, ডাকাতরা দরজা ভেঙে আমাদের ঘরে ঢোকার পর সকলকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে এবং আমার নাম ধরে আমাকে খুঁজতে থাকে। আমি আমার কক্ষ থেকে বের হবার সময়ই তাদের দেখে আমি দরজা বন্ধ করে দিতে চাইলে তারা ধস্তাধস্তি শুরু করে।
এপর্যায়ে তারা অস্ত্র দিয়ে আমার হাতে আঘাত করলে হাত কেটে যায়। তারপরে আমি দরজা লাগিয়ে চিৎকার করি এবং ফোন কলে এলাকাবাসীকে ডাকলে ডাকাতরা পালিয়ে যায়। তবে ডাকাতরা একটি দেশিয় অস্ত্র ফেলে চলে যায়, পরে পুলিশ সেটি উদ্ধার করে নিয়ে যায়।
এ বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি দিবাগত গভীর রাতে মতিগঞ্জ ইউনিয়নের ভাদাদিয়া গ্রামের আমেরিকা প্রবাসী পলাশের বাড়িতে ১২-১৫ জনের ডাকাতদল হানা দিয়ে জানালার গ্রিল কেটে ঘরে প্রবেশ করে।
এ সময় তাদের বাড়ির প্রতিনিধি ও ভাগিনা রুহানকে বেঁধে রেখে বিদেশি মুদ্রাসহ ঘরের মূল্যবান জিনিসপত্র খোঁজ করে এবং যা পেরেছে নিয়ে গেছে।
পলাশ জানান, আমি আমেরিকার প্রবাসী এবং ছোট ভাই তানভীর পর্তুগাল প্রবাসী। আমরা তখন ছুটিতে বাড়িতে গিয়েছিলাম, ভাগ্যক্রমে ডাকাতি রাতের আগে বিদেশে উদ্দেশ্যে রওনা হই। ছোট ভাই বাড়ি ছিল না। সম্ভবত ডাকাতরা সেখবর জানতো না।
এ প্রসঙ্গে তিনি অভিযোগ করে বলেন, ভুক্তভোগী হিসেবে ফোনে যোগাযোগ হলে পুলিশ বলেছে আমরা ডিউটিতে আছি, আচ্ছা আমরা দেখি কী করা যায়।
এরপরও নিরাপত্তার স্বার্থে ঘটনার দুই সাপ্তাহ পর আমার ছোট ভাই তানভীরকে পাঠিয়ে থানায় লিখিত দিয়েছিলাম, অভিযোগ আকারে গ্রহণ হয়েছে তবে মামলা হয়নি।
এ বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি পুলিশ পরিচয়ে মতিগঞ্জ ইউনিয়নের ভোয়াগ গ্রামের রবীন্দ্র কুমার করের বাড়ির চন্দ্র কুমার করের ঘরে প্রবেশ করে ডাকাতদল। এ সময় জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯এ কল করেও ডাকাত দলের হাত থেকে রক্ষা পায়নি প্রবাসী পরিবার।
সে সময় ডাকাতদল ভুক্তভোগীদের খড়ের গাদায় এবং গোয়ালঘরে অগ্নিসংযোগ করে এবং ঘরের দরজা না খুললে তাদের বসতঘরেও আগুন দেবে বলে দরজা খুলতে বাধ্য করে। এরপর ডাকাতদলের ৬ জন ঘরে ঢুকে দুই ভরি ওজনের স্বর্ণের গহনা এবং নগদ ৩৫-৪০ হাজার টাকাসহ মূল্যবান মালামাল লুট করে নিয়ে যায়।
ভুক্তভোগী চন্দ্রন কুমার করের ছেলে সুমন কুমার কর অভিযোগ করেন, এ ঘটনায় থানায় কোনও মামলা তো দূরে থাক, একটি লিখিত অভিযোগও হয়নি। পুলিশ ঘটনা সময় এসেছে এবং দিনেও এসেছিল, শুধু লিখিত অভিযোগ দিতে বলেছিল। বাড়িতে পুরুষ হিসেবে আমি একাছিলাম এবং এই ঘটনার পর বাহিরে চলে যাবো চিন্তা করেছি। সহযোগিতা না পেয়ে থানায় লিখিত অভিযোগ করা হয়নি।
অনেক ক্ষেত্রে ডাকাতির পর পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে আর কিছুই হয় না। উদ্ধার হয়না চুরি বা ডাকাতি হওয়া মালামাল, গ্রেফতার হয় না কোনও আসামি।
ডাকাতির অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সোনাগাজী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. শফিকুর রহমান বলেন, অনেকে না বুঝেই চুরির ঘটনাকে ডাকাতি বলেন।
এক ভুক্তভোগীর এমন একটি ঘটনার বিষয়ে থানায় অভিযোগ দিলে পরবর্তী পুলিশ তদন্ত শুরু করেন। যেখানে জায়গা-জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে ডাকাতির অভিযোগ দিতে দেখা গেছে। ডাকাতির ঘটনা হলে মামলা হয় না বিষয়টি সঠিক নয়, পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে সত্যতা পেলে অবশ্যই মামলা নেওয়া হয়।
এ ব্যাপারে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ডাকাতির অভিযোগের ক্ষেত্রে প্রাথমিক তদন্তে সত্যতা পেলে মামলা নেওয়া হয়। যদি তথ্য প্রমাণ থাকার পরেও থানায় মামলা না নেওয়া হয় তাহলে ভুক্তভোগী প্রতিকার চেয়ে পুলিশ বিভাগে অভিযোগ করতে পারেন। সেক্ষেত্রে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব।
সোনাগাজী থানার কর্মতৎপরতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, এ ধরনের ঘটনাগুলোতে বিভিন্ন সময় নিজেদের দ্বন্দ্বের জের ধরে অনেকে ডাকাতির মামলা সাজাতে চায়। সেক্ষেত্রে পুলিশ তদন্ত করে। তবে যে কোনও অপরাধের বিষয়ে থানা পুলিশ আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে।
ডাকাতির এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে মামলা না হওয়া প্রসঙ্গে অ্যাডভোকেট মেসবাহ উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, ডাকাতি ফৌজদারি অপরাধ বা ধর্তব্য অপরাধ। ডাকাতি গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। এ ধরনের ঘটনায় পুলিশ সরাসরি মামলা রেকর্ড করতে ও তদন্ত শুরু করতে বাধ্য। যদি ভুক্তভোগী লিখিত অভিযোগও দেন, এটিকে সরাসরি মামলায় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে আইনে বলা আছে।
কখনো কখনো দেখা যায়, থানায় ভুক্তভোগী মামলা করতে এলে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সরাসরি মামলা না নিয়ে প্রথমে শুধু লিখিত অভিযোগ নিয়ে দায় এড়িয়ে যান। এর কারণ হতে পারে থানায় মামলার সংখ্যা কম দেখানো, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অপরাধের সংখ্যা কম দেখানো, মামলার তদন্তের চাপ এড়িয়ে যাওয়া কিংবা স্থানীয় প্রভাবশালীদের প্রভাব বা সুপারিশ। তবে তিনি মনে করেন দলীয় সরকার না থাকায় পুলিশ তাদের ইচ্ছেমতো কাজ করছে। জনগণের কাছে কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে না।