ঢাকা ১০:০৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল ২০২৫, ২ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
রাণীশংকৈলে যথাযথ মর্যাদায় শুভ নববর্ষ পালিত পশ্চিম গুজরায় পাঁচ শত বছরের প্রাচীন শ্রীশ্রী ক্ষেত্রপাল বিগ্রহ পূজা অনুষ্ঠিত পহেলা বৈশাখে ঢাকুরিয়া ইউনিয়ন বিএনপির বনভোজন: দলীয় ঐক্য ও সৌহার্দ্য বৃদ্ধির প্রত্যয় যশোর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বর্ষবরণের বর্ণিল আয়োজন যশোরে মা-ছেলেকে জখমের ঘটনায় প্রধান আসামি আটক ঝিনাইদহে বিএনপির বর্ণাঢ্য বৈশাখ বরণ উৎসব রঙেঢঙে নানা আয়োজনে নববর্ষে বর্ণিল বাকৃবির বৈশাখী চত্বর হরিপুরে নানান কর্মসূচিতে পহেলা বৈশাখ-১৪৩২ উদযাপন ‎ সমাদর ক্লাবের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গুনীজন সংবর্ধনা ও পুরস্কার বিতরণ সম্পন্ন চট্টগ্রামে নববর্ষ উদযাপন মঞ্চ ভাঙচুর আটক-৬: দেশে অস্থিরতা ষড়যন্ত্রে দুর্বৃত্তরা

খেজুর ভাঙা: খেজুর গাছের চূড়ায় বিশ্বাসের উৎসব

নিজস্ব প্রতিনিধি
  • আপডেট সময় : ০৮:০৬:২৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৩ এপ্রিল ২০২৫ ১৬ বার পড়া হয়েছে

এমদাদুল হক, মনিরামপুর প্রতিনিধিঃ- চৈত্রের শেষ বিকেলে সন্ন্যাসীরা উঠে যান গাছের মাথায়, নেমে আসে খেজুর—ভরে ওঠে মানুষের হাত, হৃদয় আর ইতিহাস পহেলা বৈশাখের আগের দিন, চৈত্র সংক্রান্তি। বছরের শেষ সূর্য ডুবে যাওয়ার আগেই বাংলাদেশের কয়েকটি অঞ্চলে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ পালন করেন এক ঐতিহ্যবাহী লোকজ উৎসব—‘খেজুর ভাঙা’। এ উৎসব ধর্মীয় আচার, সংস্কৃতি ও সামাজিক মিলনের এক অপূর্ব নিদর্শন।

এই উৎসবকে ঘিরে একটি নির্দিষ্ট খেজুর গাছকে আগেভাগেই চিহ্নিত করে রাখা হয়। তিন দিন আগে থেকে প্রস্তুতি শুরু করেন যাঁরা গাছে উঠবেন—তাঁদের বলা হয় ‘সন্ন্যাসী’। তাঁরা তিন দিন ধরে উপবাস থেকে স্নান ও পবিত্রতা পালন করেন। আত্মসংযম ও নিষ্ঠার মাধ্যমে তাঁরা নিজেদের প্রস্তুত করেন ধর্মীয় এই আচার পালনের জন্য। এই খেজুর ভাঙার মূল মুহূর্ত শুরু হয় চৈত্র মাসের শেষ বিকেলে। তখন গ্রামের মানুষেরা দল বেঁধে জড়ো হয় সেই নির্দিষ্ট খেজুর গাছের নিচে। সন্ন্যাসীরা প্রস্তুত হয়ে ওঠেন খেজুর গাছে উঠার জন্য। সেই মুহূর্তে পুরো গ্রামে নেমে আসে এক ধরনের নীরব উত্তেজনা—যেন সময় থেমে থাকে।

যখন একজন সন্ন্যাসী গাছে উঠেন, শতশত চোখ তখন আকাশপানে চেয়ে থাকে। তিনি উপরে উঠে একে একে খেজুর ছিঁড়ে নিচে ফেলে দেন। নিচে অপেক্ষা করা মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে আনন্দের জোয়ার। কেউ ছুটে গিয়ে কুড়িয়ে নেয় খেজুর, কেউ হাত পেতে অপেক্ষা করে। কারও বিশ্বাস এতে আশীর্বাদ আসে, কারও মনে হয় এক বছরের সৌভাগ্য এই খেজুরেই বাঁধা।

এই খেজুর কেউ বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পূজায় ব্যবহার করে, কেউ সযত্নে রেখে দেয়, কেউ আবার পরিবারের সবার সঙ্গে ভাগ করে খায়। ছোট ছোট শিশুরাও এই খেজুর কুড়িয়ে আনার জন্য একধরনের উৎসাহে মেতে ওঠে। তাদের চোখেমুখে খেলে যায় খাঁটি আনন্দ, যা শহরের বিলাসী উৎসবেও দেখা যায় না।

সামাজিকভাবে এই উৎসব শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং এটি একটি মিলনমেলা। অনেক মুসলিম প্রতিবেশীও এদিন উপস্থিত থাকেন, কেউ দেখেন, কেউ সাহায্য করেন। কেউ কেউ বলেন, “এই উৎসবটা আমাদের ছোটবেলার স্মৃতিতে গাঁথা। ধর্ম নয়, এটা আমাদের গ্রামের রীতি।”

তবে দুঃখজনকভাবে, এই উৎসবের জৌলুশ আগের মতো নেই। আধুনিকতা আর নতুন প্রজন্মের উদাসীনতায় অনেক গ্রামেই আজ হারিয়ে যাচ্ছে এই অনন্য ঐতিহ্য। তাই দরকার—সংরক্ষণ। দরকার প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই সংস্কৃতির গল্প বলা, এই বিশ্বাসের উত্তরাধিকার তুলে ধরা।

‘খেজুর ভাঙা’ কেবল খেজুর ছিঁড়ে ফেলার নাম নয়, এটি আত্মশুদ্ধির, সামাজিক ঐক্যের এবং লোকজ ঐতিহ্যের এক গভীর প্রতীক। যতদিন এই খেজুর গাছে ওঠা হবে, ততদিন বাংলার মাটিতে বিশ্বাস আর ঐতিহ্যও বেঁচে থাকবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য

দৈনিক বাংলাদেশের চিত্র একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল। এই পত্রিকার মূল স্লোগান হলো "সত্য প্রকাশে আপোষহীন"।আমরা এ দেশের নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের কথা বলি।একজন অসহায় মানুষের পাশে দাড়িয়ে অন্যায় প্রতিরোধে সাহায্য করতে আমরা সর্বদা অঙ্গীকারবদ্ধ।দৈনিক বাংলাদেশের চিত্র পত্রিকা গনমানুষের কথা বলে।
ট্যাগস :

খেজুর ভাঙা: খেজুর গাছের চূড়ায় বিশ্বাসের উৎসব

আপডেট সময় : ০৮:০৬:২৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৩ এপ্রিল ২০২৫

এমদাদুল হক, মনিরামপুর প্রতিনিধিঃ- চৈত্রের শেষ বিকেলে সন্ন্যাসীরা উঠে যান গাছের মাথায়, নেমে আসে খেজুর—ভরে ওঠে মানুষের হাত, হৃদয় আর ইতিহাস পহেলা বৈশাখের আগের দিন, চৈত্র সংক্রান্তি। বছরের শেষ সূর্য ডুবে যাওয়ার আগেই বাংলাদেশের কয়েকটি অঞ্চলে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ পালন করেন এক ঐতিহ্যবাহী লোকজ উৎসব—‘খেজুর ভাঙা’। এ উৎসব ধর্মীয় আচার, সংস্কৃতি ও সামাজিক মিলনের এক অপূর্ব নিদর্শন।

এই উৎসবকে ঘিরে একটি নির্দিষ্ট খেজুর গাছকে আগেভাগেই চিহ্নিত করে রাখা হয়। তিন দিন আগে থেকে প্রস্তুতি শুরু করেন যাঁরা গাছে উঠবেন—তাঁদের বলা হয় ‘সন্ন্যাসী’। তাঁরা তিন দিন ধরে উপবাস থেকে স্নান ও পবিত্রতা পালন করেন। আত্মসংযম ও নিষ্ঠার মাধ্যমে তাঁরা নিজেদের প্রস্তুত করেন ধর্মীয় এই আচার পালনের জন্য। এই খেজুর ভাঙার মূল মুহূর্ত শুরু হয় চৈত্র মাসের শেষ বিকেলে। তখন গ্রামের মানুষেরা দল বেঁধে জড়ো হয় সেই নির্দিষ্ট খেজুর গাছের নিচে। সন্ন্যাসীরা প্রস্তুত হয়ে ওঠেন খেজুর গাছে উঠার জন্য। সেই মুহূর্তে পুরো গ্রামে নেমে আসে এক ধরনের নীরব উত্তেজনা—যেন সময় থেমে থাকে।

যখন একজন সন্ন্যাসী গাছে উঠেন, শতশত চোখ তখন আকাশপানে চেয়ে থাকে। তিনি উপরে উঠে একে একে খেজুর ছিঁড়ে নিচে ফেলে দেন। নিচে অপেক্ষা করা মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে আনন্দের জোয়ার। কেউ ছুটে গিয়ে কুড়িয়ে নেয় খেজুর, কেউ হাত পেতে অপেক্ষা করে। কারও বিশ্বাস এতে আশীর্বাদ আসে, কারও মনে হয় এক বছরের সৌভাগ্য এই খেজুরেই বাঁধা।

এই খেজুর কেউ বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পূজায় ব্যবহার করে, কেউ সযত্নে রেখে দেয়, কেউ আবার পরিবারের সবার সঙ্গে ভাগ করে খায়। ছোট ছোট শিশুরাও এই খেজুর কুড়িয়ে আনার জন্য একধরনের উৎসাহে মেতে ওঠে। তাদের চোখেমুখে খেলে যায় খাঁটি আনন্দ, যা শহরের বিলাসী উৎসবেও দেখা যায় না।

সামাজিকভাবে এই উৎসব শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং এটি একটি মিলনমেলা। অনেক মুসলিম প্রতিবেশীও এদিন উপস্থিত থাকেন, কেউ দেখেন, কেউ সাহায্য করেন। কেউ কেউ বলেন, “এই উৎসবটা আমাদের ছোটবেলার স্মৃতিতে গাঁথা। ধর্ম নয়, এটা আমাদের গ্রামের রীতি।”

তবে দুঃখজনকভাবে, এই উৎসবের জৌলুশ আগের মতো নেই। আধুনিকতা আর নতুন প্রজন্মের উদাসীনতায় অনেক গ্রামেই আজ হারিয়ে যাচ্ছে এই অনন্য ঐতিহ্য। তাই দরকার—সংরক্ষণ। দরকার প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই সংস্কৃতির গল্প বলা, এই বিশ্বাসের উত্তরাধিকার তুলে ধরা।

‘খেজুর ভাঙা’ কেবল খেজুর ছিঁড়ে ফেলার নাম নয়, এটি আত্মশুদ্ধির, সামাজিক ঐক্যের এবং লোকজ ঐতিহ্যের এক গভীর প্রতীক। যতদিন এই খেজুর গাছে ওঠা হবে, ততদিন বাংলার মাটিতে বিশ্বাস আর ঐতিহ্যও বেঁচে থাকবে।