সাভারে পুলিশের বিরুদ্ধে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়

- আপডেট সময় : ০৬:৩১:৫৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ ১৬৯ বার পড়া হয়েছে

সাভারে পুলিশের বিরুদ্ধে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়
ঢাকার সাভারে মারামারি মামলায় এজাহার ভুক্ত ৫ নম্বর আসামি ছোট ভাই হাসিব হাসান প্রান্তকে না পেয়ে বাসা থেকে ঘুমন্ত অবস্থায় বড় ভাই গার্মেন্টস কর্মী জিহাদ হাসান শান্তকে আটক করে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে পুলিশের পিকআপে তুলে ঘন্টা ব্যাপী বেধড়ক লাঠিচার্জ ও শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে সাভার মডেল থানা পুলিশের বিরুদ্ধে।
মঙ্গলবার দিবাগত (২১ ফেব্রুয়ারি) গভীর রাতে সদর ইউনিয়নের কলমা এলাকায় পুলিশ কতৃক এই নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। পরে অবশ্য ছোট ভাইকে পেয়ে ৯ হাজার টাকার বিনিময়ে বড় ভাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এতে গুরুতর আহত নির্যাতনের শিকার ওই গার্মেন্টস কর্মীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
নির্যাতনের শিকার জিহাদ হাসান শান্ত (২৬) গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী থানার মহাদিপুর ইউনিয়নের চন্ডিপুর গ্রামের সাইফুল ইসলাম লিটনের বড় ছেলে। শান্ত দীর্ঘদিন যাবত সাভার সদর ইউনিয়নের কলমা এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে স্থানীয় একটি পোশাক কারখানায় চাকুরি করে স্ত্রীসহ বসবাস করে আসছিল।
এ নিয়ে তার ব্যবসায়ী বাবা সাইফুল ইসলাম লিটন ও গার্মেন্টস কর্মী মা রুকসানা বেগম দম্পত্তির পরিবারে এখন চলছে বুকফাটা মাতম। তারা নিরপরাধ বড় ছেলেকে পাশবিক নির্যাতনের ঘটনায় জড়িত পুলিশ অফিসার, সাভার মডেল থানা পুলিশের উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এসআই) আল মামুন কবিরের বিচার দাবি করেছেন। বিষয়টির নিন্দা জানিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষও।
বুধবার (২১ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে নির্যাতনের শিকার শান্তকে নিয়ে বাবা সাইফুল ইসলাম লিটন ও মা রুকসানা বেগম স্থানীয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের কাছে এসে ঘটনাটি জানিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
তারা অভিযোগ করে বলেন, আমার ছোট ছেলে অপরাধী হলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করুক। কিন্তু আমার নিরীহ বড় ছেলেকে ঘুম থেকে তুলে দুই ঘন্টা হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে পুলিশের গাড়িতে ঘুরিয়ে শারীরিক নির্যাতন করলো কেন, আমরা ঘটনার বিচার চাই।
তারা বলেন, আগে বড় ছেলেসহ সাভার সদর ইউনিয়নের কলমা এলাকায় একসাথে থাকলেও এখন আমরা স্বামী-স্ত্রী ছোট ছেলেকে নিয়ে কলমা জিনজিরা রোডে আলাদা থাকি। ২১শে ফেব্রুয়ারি রাত ১ টায় আমার বড় ছেলের বর্তমান বাসায় গিয়ে তাকে ঘুম থেকে তুলে আটক করে পুলিশের গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়। শান্ত আমাদের বর্তমান বাসার ঠিকানার কথা জানতো না কিন্তু পুলিশ তাকে মারধর করে ঠিকানা জানার চেষ্টা করেছে। দুই ঘন্টা ধরে পুরো এলাকায় ঘুরিয়েছে আর কনস্টেবলসহ তার সহযোগীরা যে যেভাবে পেরেছে, আমার ছেলেকে মেরেছে। এক পর্যায়ে ছালেহ নামে এক পুলিশের সোর্স এর মাধ্যমে আমাদের বর্তমান ভাড়া বাড়ির ঠিকানায় আসে পুলিশ। তখন রাত প্রায় তিনটা বাজে।
তারা অভিযোগ করে বলেন, আমার ছোট ছেলেকে আমাদের সামনেই হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে পা-সহ বেঁধে ফেলার পর ঘর থেকে বের করার সময় সাভার থানা পুলিশের এস আই আল মামুন কবির বলে আমার বড় ছেলেও নাকি তাদের গাড়িতে রয়েছে। একথা শোনার পর আমরা হাউমাউ করে কেঁদে পুলিশ অফিসারের পায়ে ধরে বলি স্যার, আমার ছোট ছেলের অপরাধ থাকলে নিয়ে যান তবে বড় ছেলে নিরপরাধ তাকে নিয়েন না। জোরাজোরির এক পর্যায়ে ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন এসআই আল মামুন কবির। ঘরে দুই হাজার টাকা ছিল সেইটা মামুন স্যারের হাতে দিছি। টাকাটা নিয়ে তিনি আমাদের অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করে বলেন আমি কি ফকিন্নি.? ভিক্ষা করতে আসছি! দ্রুত ব্যবস্থা করে দিতে পারলে দে! নইলে উপরের অর্ডার আছে দুই ডারেই ক্রসফায়ারে দিমু! পরে বড় ছেলের মোবাইলে নগদ একাউন্টে বেতনের সাড়ে সাত হাজার টাকা আছে এই কথা শোনার পর বড় ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে বড় ছেলের ব্যবহৃত মোবাইল সহ ছোট ছেলেকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সকালে বাকি ৪০ হাজার টাকা নিয়ে থানায় দেখা করতে বলেন এসআই আল মামুন কবির যোগ করেন ওই দম্পতি বাবা-মা।
ভুক্তভোগী- থানা ও স্থানীয় সূত্র জানায়, চলতি বছরের গত ২৬ জানুয়ারি রাত সাড়ে ৯ টায় সাভার মডেল কলেজ সংলগ্ন ডগরমোড়া ঢাল এলাকায় দুই কিশোর গ্যাং-গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে উভয় পক্ষের অন্তত সাতজন আহত হয়। এ ঘটনায় গত ২ ফেব্রুয়ারি একপক্ষের দায়ের করা মারামারি মামলায় সাভার মডেল থানা পুলিশের এসআই আল মামুন কবির সাইফুল ইসলাম লিটনের ছোট ছেলে এজাহারভুক্ত ৫ নং অভিযুক্ত আসিফ হাসান প্রান্তকে মামলার আসামি হিসেবে গ্রেফতার করতে তার বড় ভাই ভুক্তভোগী জিহাদ হাসান শান্তর বাসায় যান। এ সময় পুলিশ ঘরে ঢুকেই ছোট ভাই প্রান্তকে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। তাকে না পেয়ে বড় ভাই শান্তর দুই হাত পিছনে দিয়ে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে মারধর শুরু করেন।
তাকে আটকের কারণ জানতে চাইলে এসআই আল মামুন কবির তাকে অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করে বলেন, তোর ভাই প্রান্ত কোথায়। তখন শান্ত বলেন আমার স্ত্রী সুমাইয়া আক্তার ছাড়া এই বাড়িতে আর কেউ থাকেনা, আগে আম্মু-আব্বু থাকতো গত মাসে পারিবারিক কারণে তারা এখন অন্য বাসায় থাকে, সেই বাসার ঠিকানা আমি জানিনা। একপর্যায়ে ঘরের জিনিসপত্র তছনছ করে শান্তকে পিকআপ ভ্যানে তোলা হয়। এরপর তাকে দুই ঘন্টা গাড়িতে ঘুরিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। পরে ৯ হাজার টাকার বিনিময়ে তাকে ছেড়ে দেয় পুলিশ।
পুলিশের এ ঘটনায় এলাকায় তোলপাড় চলছে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে অভিযুক্ত এসআই আল মামুন কবিরসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
এই ঘটনার প্রায় দের মাস আগে ২০২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর এসআই আল মামুন কবির তার ব্যক্তিগত সাদা রংয়ের প্রাইভেট কারে করে ঢাকা মেট্রো-গ ১৩-৭০৭১ সাদা পোশাকে কয়েকজন সহযোগীসহ সাভার সদর ইউনিয়নের চাঁপাইন এলাকায় বিভিন্ন বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করে টাকা আদায় করছিল। এ সময় নামের ভুলে বিএনপি নেতার তকমা লাগিয়ে কল মিস্ত্রি শ্রমিক সজলকে আটক করে তার স্ত্রীর কাছে ৫০ হাজার টাকা দাবি করে। ঘটনা এলাকায় জানাজানি হলে ওই এলাকার বাসিন্দা ইংরেজি দৈনিক দ্যা নিউ ন্যাশন পত্রিকার সাভার প্রতিনিধি এস এম মনিরুল ইসলাম ঘটনাস্থলে হাজির হলে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তাকেও দেড় ঘন্টা আটকে রেখে মারধর ও মাদক মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে এসআই আল মামুন কবিরের বিরুদ্ধে। সেখান থেকে তড়িঘড়ি করে স্থানীয়দের কাছে ক্ষমা চেয়ে পালিয়ে যাওয়ার পরে বিষয়টি গণমাধ্যমে আসলে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
এই ঘটনার বিচার চেয়ে এসআই আল মামুন কবিরসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী সাংবাদিক এস এম মনিরুল ইসলাম। অভিযোগ এখনো তদন্তাধীন রয়েছে বলে জানিয়েছেন সাভার মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আকবর আলী খান। এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করে আল্টিমেটাম দিয়ে রেখেছেন সাংবাদিক নেতারা।
সূত্র জানায়, এসআই আল মামুন কবিরের বিরুদ্ধে সাংবাদিক পেটানো ও টাকার বিনিময়ে আসামি ছেড়ে দেওয়ার মতো অপকর্মের ঘটনা নতুন নয়। সাভার থানায় দায়িত্ব পালনের আগে আশুলিয়া থানায় ছিলেন তিনি। এ সময় অবৈধ উপায়ে উপার্জিত অর্থে প্রায় দেড় কোটি টাকা দামে নামে-বেনামে আশুলিয়ার ডিওএইচএস এলাকায় একাধিক ফ্ল্যাট ক্রয় করেছেন আল মামুন কবির। তার অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অনেক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা নাকি তার পকেটে থাকে এমন গল্পও মানুষকে শোনান বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তা আল মামুন কবির। আশুলিয়া থানায় দায়িত্ব পালনকালে ঢাকা জেলার সাবেক এক পুলিশ সুপারের সাথে বিবাদে জড়িয়ে হুমকি স্বরূপ “বেয়াদপ কোটা’য় মামুনের চাকরি হয়েছে বলে ওই পুলিশ সুপারকে অসম্মান সূচক সম্বোধন করেন। পরে অভিযুক্ত আল মামুন কবিরকে ভৎসনা করেন ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। সিনিয়র অফিসারের সাথে বেয়াদবি করে পার পাওয়ায় দিন দিন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছেন এসআই আল মামুন কবির, এমন অভিযোগ করেছেন খোদ পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা।
প্রশ্ন উঠেছে এসআই আল মামুন কবিরের খুঁটির জোর কোথায়.?