শাল্লায় পিআইসি গঠনে হ-য-ব-র-ল

- আপডেট সময় : ০৫:৫৪:৪৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ১৯ বার পড়া হয়েছে

তৌফিকুর রহমান তাহের,(সুনামগঞ্জ)দিরাই-শাল্লা প্রতিনিধিঃ
সুনামগঞ্জের শাল্লায় ২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরে ফসলরক্ষা বাঁধের পিআইসি গঠনে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। কোথাও টাকা নিয়ে পিআইসি গঠনের অভিযোগ, কোথাও বা একই পরিবারের একাধিক সদস্য, আবার কোনো কোনো পিআইসিতে আপন ভাইয়ের পিতার নাম ভিন্ন ভিন্ন! অন্যদিকে জমি নেই এমন লোকজনদের সভাপতি করে তাদের নামে দেয়া হয়েছে পিআইসি। কোথাও আবার পিআইসিতে স্কুলের দপ্তরির নাম। আবার স্টিফিং করার নামে এক্সভেটর দিয়ে পুরনো বাঁধের গোড়ার সমস্ত বস্তিমাটি কুঁড়ে তোলা হচ্ছে বাঁধের উপরে। এমনও দেখা গেছে কুশিয়ারা নদীর পাড় কেটে বালু মিশ্রিত মাটিও ফেলা হচ্ছে বাঁধে। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে শতাধিক পিআইসির বিপরীতে জমা পড়ে অভিযোগের স্তূপ। এমনকি অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করার অভিযোগও উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে উপজেলা কাবিটা স্কীম ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ও সদস্য সচিবের দিকে উঠেছে অভিযোগের তীর। এমন দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ তুলে পিআইসি গঠনের পূর্বে ও পরে উপজেলায় বিক্ষোভ দফায় দফায় বিক্ষোভ মিছিল করেছে কৃষকরা।
ছায়ার হাওর উপ-প্রকল্পের আওতায় ৩৭নং পিআইসির সভাপতি প্রসেনজিৎ দাস বলেন এই পিআইসি আমাকে দিছে। আমরা ৪০ভাগ কাজও করছি। পরে এসও মোটা অংকের টাকা খাইয়া অন্যদের দিয়া দিছে পিআইসি। ওই প্রকল্পের সদস্য সচিব রিপন চন্দ্র দাসও একই কথা বলেন।
একই হাওরের ৪৪নং পিআইসির আবেদনকারী সভাপতি রুহুল আমিন বলেন এই পিআইসি ইউএনও, এসও স্যার আমারে দিছে। এই পিআইসি আবার ১৮তারিখ (জানুয়ারি) এসও টাকা খাইয়া মেহেদিরে দিয়া দিছে। আমি ৬০পার্সেন্ট কাজ করার পরে বাঁধা বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। টাকার বেশি দিলেই কমিটি পরিবর্তন হয়ে যায়। এই অবস্থা চলছে উপজেলায়।
অন্যদিকে ভান্ডাবিল হাওর উপ-প্রকল্পের আওতায় ৭৯নং পিআইসির সভাপতি বিমল দাস একজন টমটম চালক। ভান্ডাবিল হাওরে একটুকরো জমি নেই তার। তবু্ও তিনি ওই প্রকল্পের সভাপতি। অথচ ভান্ডাবিল হাওরের বড় বড় কৃষকরা বলছেন প্রতি বছরই তারা পিআইসির জন্য আবেদন করেন। কিন্তু তাদের পিআইসি দেয়া হয়না। আঙ্গারুয়া গ্রামের কমরেড শ্রীকান্ত দাসের বড় ছেলে দুরন্ত দাস বলেন এই হাওরে আমার জমি আছে ২০কেয়ার। আমার জমি বিনাশ করে প্রতি বছরই পিআইসির বাঁধ দেয়া হয়। আমি প্রতি বছরই আবেদনও করি। কিন্তু আমাকে পিআইসি দেয়া হয়না। অথচ বাড়ি তৈরি করার জন্য আমার কাছ থেকেই ১কেয়ার জায়গা কিনেছে তারা। বিমল দাসের বাড়ি আনন্দপুর। এই জায়গায় এবছর তারা নতুন বাড়ি করে বসবাসও করছে। কিন্তু টমটম চালক বিমল দাস কীভাবে পিআইসির সভাপতি হয়?
তিনি বলেন এর পেছনে রয়েছে এক সাংবাদিক। তার ছোট নিতেশ দাসকে ওই প্রকল্পের সদস্য সচিব করা হয়েছে। প্রতি বছরই সে এই পিআইসি নেয় নানা কৌশলে। তাছাড়া এবছর এই পিআইসির কোনো প্রয়োজন ছিল না। এই পিআইসি এবছর অযথা দেয়া হয়েছে।
আনন্দপুর গ্রামের বড় কৃষক সুবোধ দাশ বলেন আমার এখানে জমি আছে ৩০কেয়ার। আমিও গত বছর আবেদন করেছিলাম। না পেয়ে লজ্জায় আর আবেদন করিনি। তবে দোষটা বিমলের নয়। তাছাড়া এবার এখানে পিআইসির দরকার ছিল না বলে জানান তিনি।
একই আরেক কৃষক জিতেন্দ্র রায় বলেন আমার ওই হাওরে জমি আছে ২০কেয়ার। আমিও গত বছর আবেদন করেছিলাম। আমাদের পিআইসি দেয়া হয়না। যেহেতু তাদের বাড়ি নেই, তাই বিমল দাসকে আমিই জমি কিনে দিয়েছি দুরন্ত দাসের নিকট থেকে। তাদের বাড়ি ছাড়া ওইখানে আর জমি নাই। এখানে বিমলকে শুধুই ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে এবছর পিআইসির প্রয়োজন ছিল না বলে তিনিও জানান। নয়াগাঁও গ্রামের বাসিন্দা প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব রামানন্দ দাসের ছেলে রুবেল দাস বলেন সভাপতি বিমল দাসের জমি নাই। নতুন জায়গায় বাড়ি করার কাগজ দিয়া পিআইসি আনছে। সেক্রেটারি নিতেশ দাসেরও জমি নাই। একথা আমি চ্যালেঞ্জ করে বলছি। ইউএনও, এসও’র যোগসাজশে এই পিআইসি দেয়া হয়েছে। আমি এই পিআইসির বিরুদ্ধে অভিযোগ করব।
এবিষয়ে বিমল দাস বলেন আমি টমটম ড্রাইভার। পিআইসি আমারে ভগবান দিছে। গোবরেরও পদ্মফুল ফুটে! যাদের মাথা আছে তারাই পারে! তবে নতুন বাড়ির কাগজ ছাড়াও বন্ধকি জমি ওই হাওরে আছে তাদের। জমি আছে নিতেশ দাসেরও। তবে সাংবাদিক তাতে জড়িত নয় বলে দাবি তার।
অন্যদিকে ভান্ডাবিল হাওরের ৭৮নং পিআইসির সভাপতি বলেন এটি ঝুমনের পিআইসি! ঝুমন আমারে দিছে। এসও’র সাথে ঝুমনের যোগাযোগ আছে। উপরে ঝুমনের লোক আছে। কোন ঝুমন জানতে চাইলে তিনি বলে ওইযে, আলোচিত ঝুমন দাস! এরপূর্বে ‘শাল্লায় টাকার বিনিময়ে পিআইসি’ শিরোনামে ৭৮নং পিআইসির বিরুদ্ধে অর্থ কেলেঙ্কারির অভিযোগে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর ওই কমিটিকে বাতিল করা হয়। সেখানে নতুন কমিটি গঠন করা হয়। ৭৮নং প্রকল্পের সভাপতি করা হয় নয়াগাঁও গ্রামের কৃপেশ চন্দ্র দাশকে। তবে ঝুমন দাশ দেশে না থাকায় তার মতামত নেয়া সম্ভব হয়নি।
অন্যদিকে ওই প্রকল্পের সদস্য সচিব গোপি কান্ত দাশ বলেন আমারে সাংবাদিকে সুপারিশ করছে। কিন্তু সমস্যা হলো আমার পিআইসির সভাপতি! আরেক সাংবাদিক বলেন এবছর সাংবাদিকদের ১০টি পিআইসি দেয়া হয়েছে। এসবের খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, কেউ নিজ নামে, কেউ আবার ভাইয়ের নামে, কেউ বা আবার বাবার নামে, কেউ শালকের নামে কেউবা আবার ধরাছোঁয়ার বাইরে গিয়ে নিজেদের পছন্দের লোক কমিটিতে রেখেছে। সচেতন কৃষকরা বলছেন, জনপ্রতিনিধিরা না থাকায় ইচ্ছেমতে পিআইসি নেয়ার সুযোগ পেয়েছে অকৃষকরা। আর এসবের সুবিধা নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন। যেকারণে পিআইসি বন্টণে অবস্থা হয়েছে অনেকটা হ-য-ব-র-ল। অন্যদিকে কাজও চলছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ৭৯নং পিআইসির অক্ষত বাঁধে মাটি ফেলা হয়েছে অমসৃণভাবে। মাটি ফেলা হয়েছে কোথাও ৬ ইঞ্চি কোথাও এক ফুট। ভাসাভাসা কাজ হয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের। এই ধরনের কাজ না করলেও হাওরের কোন ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে জানান কৃষকরা। এসব দুর্নীতির তদন্ত করে অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছে হাওর বাঁচাও আন্দোলন উপজেলা কমিটি। এবিষয়ে মুঠোফোনে উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের শাখা কর্মকর্তা (এসও) রিপন আলী বলেন ৭৯নং পিআইসির বিষয়টি আপনি তো এখন বললেন, আমি তদন্ত করে দেখবো।