জমির লোভে জান্নাতীর রক্তে রাঙা হলো কুড়িগ্রামের ভুট্টা ক্ষেত

- আপডেট সময় : ১২:১৮:১৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৪ মে ২০২৫ ২০৮ বার পড়া হয়েছে

গালিব খাঁন,নিজস্ব সংবাদদাতা:-
ভোরবেলার সূর্য ওঠেনি তখনও। ভুট্টা খেতের উপর শিশির জমে আছে। হঠাৎ সেদিকে ছুটে আসে কিছু শব্দ—চিৎকার নয়, যেন দমবন্ধ করা কান্নার আওয়াজ। একটু পর, নিস্তব্ধতা। আর কিছুক্ষণ পরেই মিললো জান্নাতীর রক্তাক্ত নিথর দেহ।
মাত্র ১৫ বছর বয়স। এখনো মুখে শিশুসুলভ লাজ। স্কুলব্যাগে অংক খাতা থাকার কথা। অথচ তার মাথার চুল জড়িয়ে রক্ত আর মাটি। দা আর রডের আঘাতে ছিন্নভিন্ন তার শরীর। আর পাশে দাঁড়িয়ে ছিল তার আপন বাবা, মা, আর চাচী।
তিনজন মিলে মেয়ে জান্নাতীকে খুন করেছে—এমন কথা শুনে প্রথমে থমকে গিয়েছিল স্থানীয়রা। কেউ বিশ্বাস করতে পারেনি। প্রথমে সন্দেহের তীর গিয়েছিল প্রতিবেশীদের দিকে। পুলিশও সেই অনুযায়ী তিনজনকে গ্রেফতার করেছিল।
কিন্তু সত্য বেশিদিন চাপা থাকেনি। কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার কুটিরহাট এলাকার সেই বাড়িতে গিয়েই রহস্যের সূত্র পেয়েছে পুলিশ। তদন্ত আর বারবার জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে এক ভয়াবহ নির্মমতা।
কারণ? জমি। মাত্র ৩২ বিঘা জমি।
এই জমির মালিকানা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিরোধ চলছিল জাহিদুল ইসলাম ও তার বড় ভাইদের সঙ্গে। সেই জমি নিজের দখলে আনতে প্রতিবেশী পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা সাজানোর ছক করেন জাহিদুল। আর সেই ‘মামলার নাটক’ সাজাতে গিয়ে বলি হল জান্নাতী—নিজের রক্ত-মাংসের কন্যা।
জান্নাতীর চোখে তখন কি ছিল?
ভয়?
বিস্ময়?
না হয়তো—অবিশ্বাস।
নিজের মা যখন তাকে ধরে রাখে, আর বাবা যখন গলায় রড দিয়ে বাড়ি মারে, তখন কি সে বিশ্বাস হারায়নি?
মেয়েটা জানতো না—জমি তার জীবনের চেয়ে দামি।
পুলিশ জানায়, হত্যার আগে পরিকল্পনা করে পুরো ঘটনাটিকে প্রতিবেশীর ওপর চাপানোর জন্য সাজানো হয়েছিলো আলামত। প্রতিবেশীকে ফাঁসাতে পরিকল্পিতভাবে ভুট্টা ক্ষেতে লাশ ফেলা হয়। কিন্তু একাধিক তথ্য বিশ্লেষণে পুলিশের সন্দেহ হয়। পরে মোবাইল ট্র্যাকিং, কললিস্ট বিশ্লেষণ, এবং একাধিক স্বাক্ষ্য নিয়ে পুনরায় তদন্ত শুরু করে রংপুর রেঞ্জের ডিবি টিম। এরপরেই স্বীকারোক্তি আসে—জান্নাতীর খুনিরা কেউ বাইরের লোক নয়, তার ঘরের মানুষ।
এখন পুলিশ হেফাজতে রয়েছে বাবা জাহিদুল ইসলাম, মা মোর্শেদা বেগম ও চাচী সাহেরা বেগম। আদালতে তারা প্রাথমিকভাবে দোষ স্বীকার করেছে।
এই সমাজ কি এতটাই ভেঙে পড়েছে? যেখানে জমি আর লোভের ওজন এত ভারি যে, সন্তানের প্রাণ সেখানে মূল্যহীন?
ভবিষ্যতে জান্নাতীদের জন্য এই পৃথিবী কি আরও ভয়ংকর হয়ে উঠবে?
এই হত্যাকাণ্ড আমাদের সমাজব্যবস্থার সামনে শুধু এক নির্মম প্রশ্নই নয়, এক অন্ধকার আয়নাও তুলে ধরে। সেই আয়নায় আমরা সবাই একবার মুখ দেখলেই বুঝবো—আমাদের ভেতরের মানুষত্বহীন নরপশুটাও দিন দিন চোখ মেলে উঠছে।
তথ্যসূত্র:
রংপুর রেঞ্জ ডিবি অফিসারদের প্রাথমিক ব্রিফিং (১৩ মে ২০২৫)
কুড়িগ্রাম উলিপুর থানার মামলা নম্বর: ১৯/২০২৫
প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় তিনজন বাসিন্দার সাক্ষাৎকার (গ্রাম: কুটিরহাট)
সংবাদপত্র: প্রথম আলো, কালের কণ্ঠ (১২–১৪ মে ২০২৫-এর প্রতিবেদনসমূহ